উইঘুর মুসলিমদের ইতিহাস
উইঘুর মুসলিম পৃথিবীর অন্যতম একটি মুসলিম সম্প্রদায়। এরা মধ্য এশিয়ায় বসবাসরত তুর্কি বংশোদ্ভূত একটি জাতি। এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বসবাস করছে। বর্তমানে উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের সিংহভাগ মানুষ বসবাস করছে এশিয়ার অন্যতম ক্ষমতাশীল দেশ চীনে। কিন্তু চীনে বসবাসরত এই উইঘুর মুসলমান সম্প্রদায় মোটেও শান্তিতে নেই। কারণ চীনে নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য এই সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রতিনিয়ত নানান অত্যাচারের স্বীকার হতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত উইঘুর মুসলিমদের নিজেদের ধর্ম ত্যাগ এবং ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অপপ্রচার চালানোর জন্য তাদের বন্দি করে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। কিভাবে পূর্ব তুর্কিস্তানের উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায় চীনের দখলে চলে এল এবং কেনই বা চীন এই সম্প্রদায়ের মানুষদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালাচ্ছে তা জানানোর জন্যই আমাদের আজকের এই আয়োজন।
উইঘুর জাতির ইতিহাস আজ থেকে প্রায় কয়েক হাজার বছরের পুরনো। পূর্বে এই জাতিকে একাধিকবার বিভিন্ন ইসলামিক দেশ যেমন- সৌদি আরব, তুর্কি শাসন করেছিল। ফলে ইসলামি শাসনের আওতায় থাকায় এই জাতির মানুষদের মধ্যে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা তুলনামুলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। পরবর্তীতে ১৮ দশকের শেষের দিকে চীনের কিং ডাইন্যাস্টি উইঘুরদের বসবাসরত কিছু জায়গা দখল করে নেয়। কিন্তু কিং ডাইন্যাস্টি এর পক্ষে দখল করা জায়গাগুলো শাসন করা সহজ ছিল না। কারণ উইঘুর মুসলিমরা প্রায়ই বিভিন্নভাবে বিদ্রোহ করতো এবং কিং ডাইন্যাস্টি এর বিরোধিতা করতো। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৩ সালে উইঘুর জাতির মানুষেরা পূর্ব তুর্কিস্তান নামক একটি দেশ প্রতিষ্ঠা করে। এসময় নিজের দখল করা জায়গা বাঁচাতে কিং ডাইন্যাস্টি সরাসরি চীনের কেন্দ্রীয় শাসকদের কাছে সাহায্য চায়। এরপর চীনের সরাসরি হস্তক্ষেপে উইঘুরদের দমিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়। এতে প্রাথমিকভাবে উইঘুররা কিছুটা দমে গেলেও তারা হার মানেনি। ১৯৪০ সালের দিকে উইঘুর নেতা আব্দুল আজিজ মাখদুম ও আব্দুল হাকিম মাখদুম প্রতিষ্ঠা করেন তুর্কিস্তান ইসলামি পার্টি এবং তারা বিভিন্নভাবে বিদ্রোহ চালিয়ে যেতে থাকেন। ফলে ১৯৪৪ সালে আবার পূর্ব তুর্কিস্তান দেশ নতুনভাবে জন্মলাভ করে।
কিন্তু পূর্ব তুর্কিস্তান নামক এই নতুন দেশটি খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কারণ, সেসময় চীনে প্রায়ই গৃহযুদ্ধ হতো। ১৯৪৯ সালের এমনই এক গৃহযুদ্ধে চীনের এক পক্ষকে সরাসরি সমর্থন করছিল আমেরিকা এবং অন্য পক্ষকে সরাসরি সমর্থন করছিল রাশিয়া। দুর্ভাগ্যবশত পূর্ব তুর্কিস্তানের ভৌগলিক অবস্থান ছিল রাশিয়া এবং চীনের কাছাকাছি। তাই যুদ্ধের সময় পূর্ব তুর্কিস্তানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এ অবস্থায় নিজেদের সুরক্ষিত রাখার জন্য পূর্ব তুর্কিস্তানের বিপুল সংখ্যক মানুষ নিজেদের দেশকে চীনের সাথে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু পূর্ব তুর্কিস্তানের অন্যতম নেতা আব্দুল হাকিম মাখদুম এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন এবং বিছিন্নতাবাদী মনোভাব পোষণ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চীন সরকার আব্দুল হাকিম মাখদুমকে বিচিন্নতাবাদী মনোভাব পোষণ করায় গ্রেফতার করে। এভাবেই চীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা উইঘুর জাতি শেষ পর্যন্ত চীনের অন্তর্ভুক্ত হয়।
আরো জানুন: পৃথিবীতে আসা ভয়ংকর ৪টি ভাইরাস
এরপর একএক করে সব কিছু বদলে যেতে শুরু করে। চীন সরকার পূর্ব তুর্কিস্তান নাম পরিবর্তন করে তাদের নতুন প্রদেশের নাম দেয় শিনজিয়াং। শিনজিয়াং হয়ে ওঠে চীনের অন্যতম বড় প্রদেশ। ধীরে ধীরে শিনজিয়াং এ চীনের হান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। দ্রুত হান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় উইঘুরদের ধর্মীয় চর্চা এবং সংস্কৃতি হুমকির মধ্যে পরে যায়। কিন্তু এতো সবকিছুর মধ্যেও নতুন করে উইঘুরদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখান জিয়াউদ্দিন ইউসুফ। তিনি ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন উইঘুরদের স্বাধীনতা আন্দোলনের দল পূর্ব তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি। জিয়াউদ্দিন ইউসুফের নেতৃত্বে নতুন করে বিছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। জিয়াউদ্দিন ইউসুফ সকল উইঘুরদের স্বাধীনতার কথা বলতে থাকেন। তিনি সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, উইঘুররা চিনা জাতি নয়, উইঘুররা হল মুসলিম জাতি। তাই উইঘুর মুসলিমদের উচিত ইসলামের পথে অবিচল থাকা। খুব দ্রুত তার এই বার্তা সকল উইঘুররা বুঝতে পারে এবং সবাই ধীরে ধীরে স্বাধীনতার পথে অগ্রগামী হতে থাকে। কিন্তু ১৯৯০ সালে উইঘুর মুসলিম এবং চিনাদের মধ্যে এক দাঙ্গায় জিয়াউদ্দিন ইউসুফের মৃত্যু হয়। জিয়াউদ্দিন ইউসুফের মৃত্যুর পর উইঘুরদের স্বাধীনতার আন্দোলন প্রায় শেষ হয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন সময় উইঘুর জাতির বিভিন্ন লোকেরা বিভিন্নভাবে নিজেদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোন আন্দোলনই ব্যাপক সাড়া ফেলতে পারেনি।
বর্তমানে চীনে উইঘুর জাতির লোকেদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। বর্তমান সময়ে চীন সরকারের বন্দি শিবিরে প্রায় ১০ লক্ষ উইঘুর জাতির মানুষ আটক রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এ ব্যাপারে চীন সরকার বলেছে, তারা উইঘুরদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য এই শিবির খুলেছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। প্রকৃতপক্ষে, এই বন্দি শিবিরে থাকা উইঘুর মুসলিমদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয় যেন তারা চীন সরকার তথা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আনুগত্য আনে এবং তাদের প্রশংসা করে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলেছে, এইসব শিবিরে যারা থাকছে তাদের জোর করে চীনের ম্যান্ডারিন ভাষা শেখানো হয়, তাদের নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সমালোচনা অথবা নিজেদের ধর্ম পরিত্যাগ করতে বলা হয়। এছাড়া আরো অনেক রকমের শারীরিক নির্যাতন করা হয় উইঘুর মুসলিমদের ওপর। শিনজিয়াং এ সংবাদ মাধ্যম নিষিদ্ধ। তাই সেখানে বন্দি শিবিরের ব্যাপারে পুরোপুরি সঠিক তথ্য জানতে পারা সম্ভব নয়। শুধু শিনজিয়াং এর ক্ষেত্রে নয়, চীনের কোন জায়াগাতেই সংবাদ মাধ্যমের খুব বেশি স্বাধীনতা নেই।
আরো জানুন: উত্তর কোরিয়া VS দক্ষিণ কোরিয়া
শিনজিয়াং এ উইঘুর মুসলিমদের ওপর যেসব নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১৮ বছরের নিচের কোনো উইঘুর বালক মসজিদে যেতে পারে না। ৫০ বছরের কম বয়সী কেউ প্রকাশ্যে নামাজ পড়তে এবং দাড়ি রাখতে পারেনা। শুধুমাত্র নামাজ পড়ার কারণে অসংখ্য মানুষের চাকরি চলে যাওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। শিনজিয়াং এ রোজা রাখা নিষিদ্ধ। কেউ রোজা রাখলে তাকে রোজা ভাঙতে বাধ্য করা হয়। সীমিত কিছু ক্ষেত্র ছাড়া সব ক্ষেত্রেই কোরআন শরিফ তেলাওয়াত নিষিদ্ধ। কোরআন শরিফ শেখা বা শেখানোর সুযোগও বন্ধ। নারীদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ। একসময় শিনজিয়াংয়ে দুই হাজার মসজিদ ছিল। কিন্তু বর্তমানে এর সংখ্যা দিন দিন কমছে। কারণ মসজিদগুলো গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে স্থাপন করা হচ্ছে পর্যটনকেন্দ্র। এভাবেই প্রতিনিয়ত উইঘুর মুসলিম জাতির লোকেদের ওপর অমানবিক অত্যাচার চালাচ্ছে চিনা সরকার যা উইঘুর জাতির মধ্যে ইসলাম ধর্মকে বিলুপ্ত করার প্রচেষ্টা।
এই ছিল চীনের দ্বারা নির্যাতিত একটি মুসলিম সম্প্রদায় উইঘুর মুসলিম জাতির ইতিহাস। আজকের বিষয়টি (ইতিহাস) ভালো লেগে থাকলে শেয়ার করুন আপনার বন্ধুদের সাথে। পৃথিবীর এরকম (জানা-অজানা) অদ্ভুত সব অজানা তথ্য জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।
এছাড়াও যদি আপনি নিয়মিত বিশ্বের ছোট ছোট অদ্ভুত, রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক বিষয় সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত থাকুন।
ফেইসবুক পেইজ:
ইউটিউব চ্যানেল:
ইনস্টাগ্রাম পেজ: The Earth Bangla
ফেইসবুক গ্রুপ:
প্রশ্নপর্ব
চীনের শিনজিয়াং প্রদেশের পূর্ব নাম কি ছিল ?
চীনের শিনজিয়াং প্রদেশের পূর্ব ছিল পূর্ব তুর্কিস্তান। ১৯৩৩ সালে উইঘুর জাতির মানুষেরা পূর্ব তুর্কিস্তান নামক একটি দেশ প্রতিষ্ঠা করে।
চীনের সবচেয়ে নির্যাতিত জাতি কোনটি ?
উইঘুর মুসলমান পৃথিবীর অন্যতম একটি নির্যাতিত জাতি কারণ চীনে নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য এই সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রতিনিয়ত নানান অত্যাচারের স্বীকার হতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত উইঘুর মুসলমানদের নিজেদের ধর্ম ত্যাগ এবং ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অপপ্রচার চালানোর জন্য তাদের বন্দি করে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে।
উইঘুরদের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা কে ছিলেন ?
উইঘুরদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখান জিয়াউদ্দিন ইউসুফ। তিনি ১৯৮৮ সালে উইঘুরদের স্বাধীনতা আন্দোলনের দল পূর্ব তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন।
বর্তমান চীন সরকারের বন্দি শিবিরে কত উইঘুর মুসলিম বন্দি আছে ?
বর্তমান সময়ে চীন সরকারের বন্দি শিবিরে প্রায় ১০ লক্ষ উইঘুর জাতির মানুষ আটক রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
শিনজিয়াং এর বন্দী শিবিরে উইঘুরদের সাথে কি করা হয় ?
চীন সরকার বলেছে, তারা উইঘুরদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য এই শিবির খুলেছে কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। প্রকৃতপক্ষে, এই বন্দি শিবিরে থাকা উইঘুরদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয় যেন তারা চীন সরকার তথা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আনুগত্য আনে এবং তাদের প্রশংসা করে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলেছে, এইসব শিবিরে যারা থাকছে তাদের জোর করে চীনের ম্যান্ডারিন ভাষা শেখানো হয়, তাদের নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সমালোচনা অথবা নিজেদের ধর্ম পরিত্যাগ করতে বলা হয়।
চীনের শিনজিয়াং প্রদেশের সংবাদ মাধ্যম নিষিদ্ধ কেন ?
উইঘুর বন্দিশিবিরে অমানবিক অত্যাচার ও শারীরিক নির্যাতন পৃথিবীর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে সেখানে সংবাদ মাধ্যম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাই সেখানে বন্দি শিবিরের ব্যাপারে পুরোপুরি সঠিক তথ্য জানতে পারা সম্ভব নয়। তবে শুধু শিনজিয়াং এর ক্ষেত্রে নয়, চীনের কোন জায়াগাতেই সংবাদ মাধ্যমের খুব বেশি স্বাধীনতা নেই।
শিনজিয়াংয়ে মসজিদ সংখ্যা কত ?
একসময় শিনজিয়াংয়ে দুই হাজার মসজিদ ছিল কিন্তু বর্তমানে এর সংখ্যা দিন দিন কমছে। কারণ মসজিদগুলো গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে স্থাপন করা হচ্ছে পর্যটনকেন্দ্র।
শিনজিয়াং এ মুসলমানদের ওপর কি কি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে ?
শিনজিয়াং এ মুসলমানদের ওপর যেসব নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১৮ বছরের নিচের কোনো উইঘুর বালক মসজিদে যেতে পারে না, ৫০ বছরের কম বয়সী কেউ প্রকাশ্যে নামাজ পড়তে এবং দাড়ি রাখতে পারেনা। শিনজিয়াং এ রোজা রাখা নিষিদ্ধ, কোরআন শরিফ তেলাওয়াত নিষিদ্ধ এবং নারীদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not Enter any spam comment or Link in the comment Box