বিশ্বের ভয়ংকর কিছু মহামারীর ইতিহাস
ভাইরাস হলো এক ধরনের অণুজীব যা সেই আদিকাল থেকে মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে আসছে। ভাইরাস একটি লাতিন শব্দ যার অর্থ হচ্ছে বিষ। এই অতি ক্ষুদ্র অণুজীবের আছে ভয়ংকর মারণ ক্ষমতা। বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রের ক্রমাগত উন্নতি সত্ত্বেও ক্ষুদ্রা এই অণুজীবের সঙ্গে লড়াইয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে মানুষ কেননা পুরনো একটি ভাইরাসের প্রভাব যেতে না যেতেই কিছুদিনের মধ্যেই দেখা দিচ্ছে আরো মারাত্মক কোনো ভাইরাস। এই নতুন ভাইরাস খুব সহজেই একজন থেকে অন্যজনের শরীরে সংক্রমণ ঘটায় আর নতুন হওয়ার কারণে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে তেমন কোনো কাজে আসে না এবং তাৎক্ষণিকভাবে এর চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহন সম্ভব হয় না। তাই যখন কোনো ভাইরাস বিশ্বের বিরাট অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, অস্বাভাবিক সংখ্যায় মানুষ আক্রান্ত হয় এবং মারা যায় তখন তা মহামারি আকার ধারণ করে।আজ আমরা ইতিহাসের এমনই ভয়ংকর ৪টি ভাইরাস সম্পর্কে জানবো যা মহামারি আকার ধারণ করেছিল এবং প্রাণ হারিয়েছিল লাখ লাখ মানুষ।
৪. প্লেগ অফ মার্শেই
ইতিহাসের তথ্যমতে, সপ্তদশ শতকে দুনিয়াজুড়ে ২০ কোটি মানুষ শুধু প্লেগ রোগে মারা যায়। ১৩৪৭ সালে প্রথম বড় বুবোনিক প্লেগ সংক্রমণ ঘটে। প্লেগ ইউরোপে কয়েক শতাব্দীকাল ধরে টিকে ছিল যার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াল রূপটি ছিল ১৭২০ সালে ফ্রান্সের দ্য গ্রেট প্লেগ অব মার্শেই এর মহামারির আঘাত। এই প্লেগে শুধু মার্শেই নগরীতে ৫০ হাজার আর পুরো ভলকান ও ফ্রান্সজুড়ে ১০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ফ্রান্সের জন্মহার প্রায় ৪৫ বছরের জন্য কমে গিয়েছিলো এই প্লেগের প্রভাবে। এই সংক্রমণের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল ভারতেরও তবে অনেক পরে। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো একক রোগে এত মানুষের মৃত্যু এর আগে কখনো ঘটে নি। তাই এই মৃত্যুর ঐতিহাসিক নাম দেওয়া হয়েছিল দ্য ব্ল্যাক ডেথ। এ সময় পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে, মৃতদেহ কবর দিতে খোড়া হয় একের পর এক গণকবর। এই মহামারি ইউরোপের ইতিহাসে ব্যাপক ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। ইতিহাসবিদরা ধারনা করেন এই মহামারীর চূড়ান্ত পর্যায়ে পৃথিবীজুড়ে প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষ মারা যেত! ইউরোপের সমাজ কাঠামো ভেঙে দিয়েছিল এই প্লেগ। ধারণা করা হয় যে এই ব্যাক্টেরিয়া সংক্রামিত মাছি বা ইদুর দ্বারা ছড়িয়ে পড়ে।
আরো জানুন: মানুষ ছাড়া পৃথিবী কেমন হবে
৩. কলেরা
১৭২০ সালের প্লেগ-এর ঠিক ১০০ বছর পর ১৮২০ সালে ভয়ঙ্কর রূপে ফিরে আসে কলেরা। ১৮১৭ সালে শুরু হয়ে ১৮২৪ সাল পর্যন্ত এর প্রভাব থাকলেও ১৮২০ সালে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায়। এশিয়াটিক কলেরা নামে পরিচিত এই অতি মহামারির শুরু কলকাতার ব্রিটিশ সেনাদের মাঝে। পরে তা প্রায় অর্ধেক পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮১৭ থেকে ১৮৮১ সালের মধ্যে মোট পাঁচবার কলেরা-র প্রাদুর্ভাব হয়েছিল ভারতে। মূলত এই কলেরা-তে আর্থিকভাবে দুর্বল শ্রেণির মধ্যে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি ছিল। ভারতে বসবাসকারী ইউরোপিয়ানরা সেভাবে এতে প্রভাবিত হয়নি। মূলত বন্যা থেকে এই রোগের উৎপত্তি হয়েছিল। তৎকালীন এক ভয়াবহ বন্যার পরেই জলবাহিত পেটের অসুখে কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। এই মহামারিতে কত লাখ লোক মারা গিয়েছিলেন তা পরিস্কার ভাবে জানা যায় নি। ইতিহাসবিদদের মতে, সেই সময়ে অল্পদিনের ব্যবধানে হাজার হাজার আক্রান্ত ব্যক্তিরা মারা যান। প্রতিদিনের আক্রান্তের সংখ্যা এমন হারে বেড়েছিল যে টা রীতিমতো ভয়ানক ছিল। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে সে সময় চীন, রাশিয়া ও ভারতে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে অন্তত ৪ কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটে।
২. স্প্যানিশ ফ্লু
১৮২০ সালের কলেরার প্রায় ১০০ বছর পর ১৯১৮ সালের শেষের দিকে ভয়ঙ্কর এক মহামারি সারা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল যার নাম ছিল স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর ফ্লু স্প্যানিশ ফ্লু নামে পরিচিত। স্প্যানিশ ফ্লুর কারণ ছিল H1N1 ভাইরাস। এর নাম স্প্যানিশ ফ্লু হলেও এর উৎপত্তি ছিল মূলত আমেরিকা। এই ফ্লু প্রথম দেখা গিয়েছিল ১৯১৮ সালের ৪ মার্চ কানসাসের আমেরিকান সেনা সদস্যদের মধ্যে। স্প্যানিশ ফ্লু নামকরণের পেছনে কারণ হলো স্পেনের সংবাদ মাধ্যম এই ফ্লুর খবরটি মুক্তভাবে পরিবেশন করছিল। স্প্যানিশ ফ্লু যখন মহামারিতে রূপ নেয়, তখন বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম সেই সংবাদ প্রচারে বাধা-নিষেধ আরোপ করলেও স্পেনের মিডিয়া ফলাও করে এই ফ্লুর কথা প্রচার করেছিল। তাই এই মহামারির নাম হয়ে যায় স্প্যানিশ ফ্লু, যদিও এর প্রভাব ছিল পুরো ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকাজুড়েই। ১৯১৮ সালে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া শুরু করে ভাইরাসটি এবং পরের দুই বছরে সারা পৃথিবীতে মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই এতে আক্রান্ত হয়। মৃত্যু হয়েছিল পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষের যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যার চাইতেও বেশি। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল যে ট্রলিতে বোঝাই করে লাশ শহর থেকে সরাতে হয়েছে, মৃতদেহ দাফনের জন্য কোণ গির্জা কিংবা যাজক পাওয়া যেত না এবং কবর খোড়ার মতো লোক পাওয়া ছিল দুষ্কর ব্যাপার।
১৯১৮ সালের মতো আবারো নতুন কোনো ফ্লু মহামারী ছড়িয়ে পড়া অসম্ভব কিছু না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা এখন ইনফ্লুয়েন্জা অতটা মারাত্মক না হলেও বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৫ লাখ মানুষ ইনফ্লুয়েন্জার কারনে মারা যায়।
আরো জানুন: পৃথিবীর নতুন সপ্তম আশ্চর্য
১. নভেল করোনা (Covid-19)
করোনাভাইরাস আসলে একক কোনো ভাইরাস নয়। এটি বেশকিছু ভাইরাস প্রজাতির বড় একটি পরিবার। সার্স, মার্সের মতো প্রাণঘাতী ভাইরাসগুলোও এ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এ পরিবারের ভাইরাসগুলো প্রাণী থেকে মানুষে এবং মানুষ থেকে প্রাণীতে সংক্রমিত হতে পারে। এ পরিবারের নবীনতম সদস্য হলো নোভেল করোনাভাইরাস। ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুর প্রায় ১০০ বছর পর ২০২০ সালের শুরুতেই চীনের উহান শহর থেকে শুরু হয় নতুন ধরনের অজ্ঞাত এই প্রাণঘাতি নোভেল করোনাভাইরাস এর প্রাদুর্ভাব। এই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসটি ইতিমধ্যে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। অজ্ঞাত এই ভাইরাস সম্পর্কে শুরুতে কোনও প্রকার তথ্য না জানা থাকায় এখনও পর্যন্ত নির্দিষ্টভাবে এর প্রতিষেধক উদ্ভাবন সম্ভব হয়নি। চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাসের কারণে থমকে গেছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। দুনিয়াজুড়ে মৃতের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এমতাবস্থায় বিশ্বজুড়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)। কিন্তু এর মধ্যে এর ভয়াল থাবার শিকার হয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের পাশাপাশি এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলো। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় ওপরের সারিতে থাকা অন্যতম দেশগুলোর মধ্যে ইতালি, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যে, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়ার নাম উল্লেখযোগ্য।
১৫ এপ্রিল ২০২০ এর সর্বশেষ তথ্যমতে, বিশ্বজুড়ে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ এবং মৃতের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার। তবে ধারণা করা হচ্ছে এর সংখ্যা আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে এবং এর সময়কাল সম্পর্কে এখনো কোনো নির্দিষ্ট ধারণা পাওয়া যায় নি।
ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যাচ্ছে প্রতি ১০০ বছর পরে নিজেকে পুনরাবৃত্তি করছে, এটি কি কেবল কাকতালীয় ঘটনা নাকি অন্য কিছু তা হয়তো সময়ই বলে দিবে। প্রতি ১০০ বছরে এমন মহামারীর হয়তো বৈজ্ঞানিক কোন কারণ মিলবে না তবে এটা স্পষ্ট প্রকৃতির উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ খুবই সীমিত।
এছাড়াও যদি আপনি নিয়মিত বিশ্বের ছোট ছোট অদ্ভুত, রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক বিষয় সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত থাকুন।
ফেইসবুক পেইজ:
ইউটিউব চ্যানেল:
ইনস্টাগ্রাম পেজ: The Earth Bangla
ফেইসবুক গ্রুপ:
প্রশ্নপর্ব
ভাইরাস কি ?
ভাইরাস একটি লাতিন শব্দ যার অর্থ হচ্ছে বিষ। ভাইরাস হলো এক ধরনের অণুজীব। এই অতি ক্ষুদ্র অণুজীবের আছে ভয়ংকর মারণ ক্ষমতা।
কত সালে পৃথিবীতে প্লেগ রোগের আগমন ঘটে ?
১৩৪৭ সালে প্রথম প্লেগ সংক্রমণ ঘটে। প্লেগ ইউরোপে কয়েক শতাব্দীকাল ধরে টিকে ছিল যার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াল রূপটি ছিল ১৭২০ সালে ফ্রান্সের দ্য গ্রেট প্লেগ অব মার্শেই এর মহামারির আঘাত।
প্লেগ রোগে পৃথিবীতে কত মানুষ মারা গিয়েছিলেন ?
ইতিহাসের তথ্যমতে, সপ্তদশ শতকে দুনিয়াজুড়ে ২০ কোটি মানুষ শুধু প্লেগ রোগে মারা যায়। ফ্রান্সের জন্মহার প্রায় ৪৫ বছরের জন্য কমে গিয়েছিলো এই প্লেগের প্রভাবে। এই সংক্রমণের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল ভারতেরও তবে অনেক পরে। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো একক রোগে এত মানুষের মৃত্যু এর আগে কখনো ঘটে নি। তাই এই মৃত্যুর ঐতিহাসিক নাম দেওয়া হয়েছিল দ্য ব্ল্যাক ডেথ।
কত সালে পৃথিবীতে কলেরা রোগ দেখা দেয় ?
১৭২০ সালের প্লেগ-এর ঠিক ১০০ বছর পর ১৮২০ সালে কলেরার ভয়ঙ্কর রূপ দেখা দেয়। ১৮১৭ সালে শুরু হয়ে ১৮২৪ সাল পর্যন্ত এর প্রভাব থাকলেও ১৮২০ সালে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায়। ১৮১৭ থেকে ১৮৮১ সালের মধ্যে মোট পাঁচবার কলেরা-র প্রাদুর্ভাব হয়েছিল ভারতে।
কলেরা রোগে কত মানুষ মারা যায় ?
মূলত এই কলেরা-তে আর্থিকভাবে দুর্বল শ্রেণির মধ্যে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি ছিল। এই মহামারিতে কত লাখ লোক মারা গিয়েছিলেন তা পরিস্কার ভাবে জানা যায় নি। তবে বিভিন্ন ইতিহাসবিদদের মতে, সে সময় চীন, রাশিয়া ও ভারতে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে অন্তত ৪ কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটে।
স্প্যানিশ ফ্লু কি ?
এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর ফ্লু স্প্যানিশ ফ্লু নামে পরিচিত। স্প্যানিশ ফ্লুর কারণ ছিল H1N1 ভাইরাস। এর নাম স্প্যানিশ ফ্লু হলেও এর উৎপত্তি ছিল মূলত আমেরিকা। যদিও এর প্রভাব ছিল পুরো ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকাজুড়েই।
নোভেল করোনাভাইরাস কি ?
করোনাভাইরাস আসলে একক কোনো ভাইরাস নয়। এটি বেশকিছু ভাইরাস প্রজাতির বড় একটি পরিবার। সার্স, মার্সের মতো প্রাণঘাতী ভাইরাসগুলোও এ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এ পরিবারের ভাইরাসগুলো প্রাণী থেকে মানুষে এবং মানুষ থেকে প্রাণীতে সংক্রমিত হতে পারে। এ পরিবারের নবীনতম সদস্য হলো নোভেল করোনাভাইরাস।
সর্বপ্রথম কোথায় করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ঘটে ?
২০২০ সালের শুরুতেই চীনের উহান শহর থেকে শুরু হয় নতুন ধরনের অজ্ঞাত এই প্রাণঘাতি নোভেল করোনাভাইরাস এর প্রাদুর্ভাব ঘটে। এর ভয়াল থাবার শিকার হয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের পাশাপাশি এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলো। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় দেশগুলোর মধ্যে ইতালি, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যে, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়ার নাম উল্লেখযোগ্য।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not Enter any spam comment or Link in the comment Box