উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়া

এশিয়া মহাদেশের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত ২টি অন্যতম দেশ হল – উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়া। গত ১০০ বছর আগেও পৃথিবীর মানচিত্রে কোরিয়া নামে একটিমাত্র দেশ ছিল। সেসময় কোরিয়ার মানুষদের সংস্কৃতি, ভাষা, নিয়ম-কানুনে কোন পার্থক্য ছিল না। কিন্তু ১৯৪৫ সালে বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে কোরিয়া দুইটিভাগে বিভক্ত হয়ে পরে। পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় ২টি ভিন্ন কোরিয়া। এরপর ১৯৪৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এই দুই কোরিয়ার সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য এবং নিয়ম-কানুনে আমূল পরিবর্তন এসেছে এবং দুইটি দেশের জনগণের জীবনযাত্রায় অনেক পার্থক্য তৈরি হয়েছে। চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার এমনই কিছু  পার্থক্য যা পুরো বিশ্বকে অবাক করবে


১. ভাষা

আমরা সবাই জানি যে, উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় ভাষা হল কোরিয়ান ভাষা। কিন্তু এখানে পার্থক্য হল কোরিয়ান শব্দের ব্যবহার এবং উচ্চারণের ক্ষেত্রে। উত্তর কোরিয়াতে কোরিয়ান ভাষার পুরোনো সংস্করণে বেশিরভাগ কথা বলা হয় এবং সেখানকার মানুষেরা যেকোনো শব্দ খাঁটি কোরিয়ান ভাষায় উচ্চারণ করতে পছন্দ করে। উত্তর কোরিয়ার মানুষেরা ইংরেজি শব্দ খুবই কম ব্যবহার করে। অন্যদিকে, দক্ষিণ কোরিয়াতে কোরিয়ান ভাষা অনেক আধুনিক রূপ লাভ করেছে এবং দক্ষিণ কোরিয়াতে প্রয়োজন অনুযায়ী ইংরেজি শব্দ কমবেশি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে উত্তর-দক্ষিন কোরিয়াতে একই শব্দ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে উচ্চারিত হয়

২. গনতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা

উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়া এই ২ দেশই গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র। অন্য সকল দেশের মত এই ২ দেশেও একটি নির্দিষ্ট সময় বা মেয়াদ পার হওয়ার পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে এক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার নির্বাচন এবং শাসনব্যবস্থাকে কিছুটা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলা যায়। কারণ উত্তর কোরিয়াতে নির্বাচনের সকল প্রার্থী সরকার কর্তৃক নির্ধারণ করে দেওয়া হয় এবং উত্তর কোরিয়ার মানুষেরা সেই নির্ধারিত প্রার্থীদের ভোট দিতে বাধ্য থাকে। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার নির্বাচন এবং শাসনব্যবস্থাকে প্রকৃতপক্ষে গনতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলা যায়। কারণ অন্যসব গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর মত দক্ষিণ কোরিয়াতে রাষ্ট্রপতি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে ৫ বছরের মেয়াদে নির্বাচিত হন। দক্ষিণ কোরিয়াতে রাষ্ট্রপতি হলেন রাষ্ট্রের প্রধান। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়াতে বেশ কিছু রাজনৈতিক দল রয়েছে। 

আরো জানুন: আমাজন জঙ্গলের ১৫টি অদ্ভুত সত্যি

৩. দারিদ্রতা

উত্তর কোরিয়ার দারিদ্রতার হার দক্ষিণ কোরিয়ার দারিদ্রতার হারের চেয়ে অনেক বেশি। উত্তর কোরিয়ার ৩০-৪০% মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। অর্থাৎ, উত্তর কোরিয়ার প্রায় ৩০-৪০% মানুষের প্রতিদিন খাওয়ার খরচ চালানোর ক্ষমতা নেই। অন্যদিকে, দক্ষিণ কোরিয়ার মাত্র ১৪.৪% মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে রয়েছে। 


৪. প্লাস্টিক সার্জারি

বর্তমান বিশ্বে প্লাস্টিক সার্জারি একটি অন্যতম ফ্যাশন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। কিন্তু উত্তর কোরিয়াতে প্লাস্টিক সার্জারি খুব বেশি মাত্রায় দেখা যায়না। কারণ উত্তর কোরিয়ার মানুষেরা দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনায় অধিক দারিদ্রতার স্বীকার। তাই উত্তর কোরিয়াতে কেউ চাইলেও প্লাস্টিক সার্জারি করাতে পারেনা। একমাত্র উত্তর কোরিয়ার ধনী ব্যক্তিরাই সেদেশে প্লাস্টিক সার্জারি করানোর ক্ষমতা রাখে। আর অন্যদিকে, প্লাস্টিক সার্জারির ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়া উত্তর কোরিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত। দক্ষিণ কোরিয়াকে বলা হয়, Plastic Surgery Capital of the World। দক্ষিণ কোরিয়াতে প্লাস্টিক সার্জারি করানো খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার।

৫. ইন্টারনেট কানেকশন

ইন্টারনেট কানেকশন থেকে উত্তর কোরিয়ার মানুষেরা পুরোপুরিভাবে বঞ্চিত। উত্তর কোরিয়ায় মোট ৩০টি সরকারি ওয়েবসাইট রয়েছে। এর বাহিরে আর কোন ওয়েবসাইট নেই। সেদেশে ফেসবুক বা গুগল মত কোন ওয়েবসাইট চালানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আবার যেহেতু উত্তর কোরিয়ায় দারিদ্রতার হার অনেক বেশি তাই সেদেশে একমাত্র ধনীরাই ইন্টারনেট ব্যবহার করার ক্ষমতা রাখে। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া ইন্টারনেটের মাধ্যমে গোটা বিশ্বের সাথে যুক্ত রয়েছে। একইসাথে পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুততম ইন্টারনেট কানেকশনের দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া অন্যতম

আরো জানুন: মানুষ ছাড়া পৃথিবী কেমন হবে

৬. পারমানবিক বোমা

উত্তর কোরিয়ার অধিকাংশ মানুষ দারিদ্রতার স্বীকার হলেও উত্তর কোরিয়ার নিজেদের তৈরি করা পারমাণবিক বোমা রয়েছে। উত্তর কোরিয়া এখন পর্যন্ত ৬ বার নিজেদের দেশে পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছে এবং তারা তাদের পরীক্ষায় সফলও হয়েছে। তবে উত্তর কোরিয়ার কাছে মোট কয়টি পারমানবিক বোমা রয়েছে তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। অন্যদিকে, দক্ষিণ কোরিয়া পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ হওয়া সত্ত্বেও এই দেশের নিজস্ব কোন পারমাণবিক বোমা নেই


৭. মিলিটারি সার্ভিস

উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়া উভয় দেশের নাগরিকদের একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মিলিটারিতে নিযুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক। উত্তর কোরিয়ায় পুরুষদের কমপক্ষে ১০ বছর এবং নারীদের ২৩ বছর বয়স পর্যন্ত মিলিটারিতে কাজ করতে হয়। অন্যদিকে, দক্ষিণ কোরিয়াতে ১৮ থেকে ২৮ বছর বয়সী পুরুষদের কমপক্ষে ২ বছরের জন্য মিলিটারিতে বাধ্যতামূলকভাবে কাজ করতে হয়। তবে দক্ষিণ কোরিয়াতে নারীদের মিলিটারিতে কাজ করার কোন বাধ্যবাধকতা নেই, যদি কোন নারী স্বেচ্ছায় মিলিটারিতে নিযুক্ত হতে চায় একমাত্র তাহলেই সে মিলিটারিতে যোগ দিতে পারে।

৮. উচ্চতা

সাধারণ দৃষ্টিতে আমাদের কাছে উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষদের দেখতে একই মনে হলেও আসলে দক্ষিণ কোরিয়ার লোকেরা উত্তর কোরিয়ার লোকেদের চেয়ে সাধারণত ৩ ইঞ্চি বেশি লম্বা হয়। তবে কোরিয়ান বাচ্চাদের মধ্যে উচ্চতার এই পার্থক্য বেশি লক্ষ্য করা যায়।

৯. সরকারি ছুটি

সরকারি ছুটির দিক থেকেও উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিন কোরিয়ার মধ্যেও অনেক পার্থক্য রয়েছে। কারণ উত্তর কোরিয়ার বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ ছুটির দিনগুলো উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম-জং-উন এর পরিবার এবং তার রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্কিত। উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ছুটির দিনগুলো হল  কিম-জং-উন এর দাদা-দাদি এবং বাবার জন্মদিন। অন্যদিকে, দক্ষিণ কোরিয়ার বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ ছুটির দিনগুলো দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে সম্পর্কিত। দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ছুটির দিনগুলো হল- ইন্ডিপেন্ডেন্স মুভমেন্ট ডে, ‘কন্সটিটিউশন ডে’, লিবারেশন ডে, ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ডে, হাঙ্গুল ডে ইত্যাদি।

আরো জানুন: পৃথিবীর নতুন সপ্তম আশ্চর্য 


১০. স্যাটেলাইট ইমেজ

শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ দিক থেকেই নয়, উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার পার্থক্য মহাকাশ থেকেও স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায়। মহাকাশ থেকে তোলা কিছু ছবিতে দেখা যায় যে, রাতে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় প্রতিটি জায়গা উজ্জ্বল এবং আলোকিত থাকে। অন্যদিকে, রাতে উত্তর কোরিয়া যেন পুরোপুরি অন্ধকারে ডুবে থাকে। স্যাটেলাইট ইমেজে উত্তর কোরিয়ার যে সামান্য আলোকিত অংশ দেখা যায় তা হল উত্তর কোরিয়ার রাজধানী - পিয়ংইয়াং।

এই ছিল উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিন কোরিয়ার কিছু অবাক করার মত পার্থক্য। যদি আপনি পৃথিবীর অন্য কোন দেশের পার্থক্য সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আমাদের অবশ্যই কমেন্ট করে জানান। আজকের বিষয়টি (সেরা ১০) ভালো লেগে থাকলে শেয়ার করুন আপনার বন্ধুদের সাথে। পৃথিবীর এরকম (জানা-অজানা) অদ্ভুত সব অজানা তথ্য জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।

এছাড়াও যদি আপনি নিয়মিত বিশ্বের ছোট ছোট অদ্ভুত, রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক বিষয় সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত থাকুন।

ফেইসবুক পেইজ: The Earth Bangla

ইউটিউব চ্যানেল: The Earth Bangla

ইনস্টাগ্রাম পেজ: The Earth Bangla

ফেইসবুক গ্রুপ: The Earth Bangla Family

প্রশ্নপর্ব

কোরিয়া কত সালে বিভক্ত হয় ?

গত ১০০ বছর আগেও পৃথিবীর মানচিত্রে কোরিয়া নামে একটিমাত্র দেশ ছিল। কিন্তু ১৯৪৫ সালে বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে কোরিয়া দুইটিভাগে বিভক্ত হয়ে পরে। পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় ২টি ভিন্ন কোরিয়া। উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়া।

উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষ কি একি ভাষায় কথা বলে?

উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় ভাষা কোরিয়ান ভাষা হলেও কোরিয়ান শব্দের ব্যবহার এবং উচ্চারণের ক্ষেত্রে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। উত্তর-দক্ষিন কোরিয়াতে একই শব্দ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে উচ্চারিত হয়।

উত্তর কোরিয়াতে কি নির্বাচন হয় ?

উত্তর কোরিয়ার নির্বাচন এবং শাসনব্যবস্থাকে কিছুটা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলা যায়। কারণ উত্তর কোরিয়াতে নির্বাচনের সকল প্রার্থী সরকার কর্তৃক নির্ধারণ করে দেওয়া হয় এবং উত্তর কোরিয়ার মানুষেরা সেই নির্ধারিত প্রার্থীদের ভোট দিতে বাধ্য থাকে।

কোন কোরিয়াতে দারিদ্রতা বেশি ?

উত্তর কোরিয়ার দারিদ্রতার হার দক্ষিণ কোরিয়ার দারিদ্রতার হারের চেয়ে অনেক বেশি। উত্তর কোরিয়ার ৩০-৪০% মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। অন্যদিকে, দক্ষিণ কোরিয়ার মাত্র ১৪.৪% মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে রয়েছে।

কোন দেশ প্লাস্টিক সার্জারির জন্য বিখ্যাত ?

দক্ষিণ কোরিয়াকে বলা হয়, Plastic Surgery Capital of the World। দক্ষিণ কোরিয়াতে প্লাস্টিক সার্জারি করানো খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার।

কোরিয়ানদের মধ্যে কারা বেশি লম্বা হয় ?

সাধারণ দৃষ্টিতে আমাদের কাছে উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষদের দেখতে একই মনে হলেও আসলে দক্ষিণ কোরিয়ার লোকেরা উত্তর কোরিয়ার লোকেদের চেয়ে সাধারণত ৩ ইঞ্চি বেশি লম্বা হয়।

Post a Comment

Please do not Enter any spam comment or Link in the comment Box

নবীনতর পূর্বতন