আমাজন জঙ্গল সম্পর্কে অবাক করা কিছু তথ্য
দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদীর অববাহিকায় অবস্থিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রেইনফরেস্ট আমাজন জঙ্গল। আমাজন জঙ্গল আমাজন অরণ্য নামেও পরিচিত। আদিবাসীদের প্রায় আদিম জীবন এবং লক্ষ লক্ষ জীবজন্তু প্রাণীকূলের যেন এক অন্য জগত এই আমাজন জঙ্গল। এটি। স্প্যানিশ পর্যটক ফ্রান্সিস দে ওরেলানাই প্রথম মানুষ যিনি আমাজন নদী ধরে পৌঁছে যান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই রেইন ফরেস্ট। প্রাচিনকাল থেকেই অভিযাত্রীরা আমাজনে যাত্রা করে মূলত স্বর্ণ, রৌপ্য এবং ধন-রত্নের খোঁজে। পর্তুগীজ অভিযাত্রীরা বিশ্বাস করত, বিশাল এ বনের মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে আছে এলডোরাডো নামক এক গুপ্ত শহর যা পুরোপুরি সোনার তৈরি। এই ভ্রান্ত ধারনাটি এসেছে গ্রীক পৌরাণিক গল্প থেকে যেখানে বলা হয়েছে যে এলডোরাডো নামক সোনায় মোড়ানো শহরটি পাহাড়া দেয় এক শ্রেনীর বিশেষ নারীযোদ্ধারা যাদেরকে গল্পে আমাজন বলে অভিহিত করা হয়েছে। পর্তুগিজ,স্প্যানিশ এবং ফ্রেঞ্চ অভিযাত্রীরা প্রতিযোগীতায় নামে এই এলডোরাডো শহর আবিষ্কারের জন্য। কিন্তু কেউ এই কাল্পনিক শহরের খোঁজ পায়নি। শহরের সন্ধান না পেলেও স্থায়ী হয়ে যায় সেই নারী যোদ্ধাদের নাম। তাদের নামানুসারেই এই জঙ্গলের নাম হয় আমাজন জঙ্গল।
আমাজন অরণ্য আমাজন নদীর অববাহিকায় অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিরক্ষীয় বন, যা দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের উত্তরভাগে অবস্থিত ৯টি দেশের অন্তর্ভুক্ত,যার ৬০% রয়েছে ব্রাজিলে, ১৩% রয়েছে পেরুতে এবং বাকি অংশ রয়েছে কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গায়ানা, সুরিনাম এবং ফরাসি গায়ানা। পৃথিবী জুড়ে যে রেইনফরেস্ট তার অর্ধেক টাই এই অরণ্য নিজেই। নানা রকম প্রজাতির বাসস্থান হিসেবে সমৃদ্ধ এই বনে প্রায় ৩৯০ বিলিয়ন বৃক্ষ রয়েছে যেগুলো প্রায় ১৬০০০ প্রজাতিতে বিভক্ত। দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের মোট আয়তনের ৪০% এই বনের দখলে।
আরো জানুন: মানুষ ছাড়া পৃথিবী কেমন হবে
আমাজনকে রেইনফরেস্ট বলা হলেও এর অর্থ কিন্তু এই না যে এখানে সারা বছর বৃষ্টিপাত হয় বরং রেইনফরেস্ট বলা হয় এখানকার অত্যধিক আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত (বর্ষা মৌসুমে) এবং গরম আবহাওয়ার কারণে। প্রচণ্ড গরমের কারণে এখানে বাষ্পীভবনের হার অনেক বেশি যা আর্দ্রতা এবং বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ। এই গরম আবহাওয়া, বৃষ্টিপাত এবং আর্দ্রতার কারণে এ বনে উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের বৈচিত্র্যময় সমাহার দেখা যায়। আমাজন জঙ্গলে আছে ১২০ ফুট উঁচু গাছ, ৪০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ, ২.৫ মিলিয়ন প্রজাতির কীট-পতঙ্গ ১,২৯৪ প্রজাতির পাখি, ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪২৮ প্রজাতির উভচর এবং ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীসহ হাজারো প্রজাতির অজানা জীব-অণুজীব। এখানকার প্রাণী বৈচিত্র্য অতুলনীয়। মজার বিষয় হলো হাজারো রকমের প্রাণীর সমাহার থাকলেও এখানকার ইকোসিস্টেম অত্যন্ত শক্তিশালী যা মিলিয়ন বছর ধরে টিকে আছে।
বিভিন্ন জীবের পাশাপশি কিছু ক্ষতিকর প্রানিও আছে আমাজন জঙ্গলে। তাদের মধ্যে পিরানহা, রক্তচোষা বাদুর, বিষাক্ত ব্যাঙ, বৈদ্যুতিক মাছ, রেবিস, ম্যালেরিয়া, ইয়েলো ফিভার, ডেঙ্গু ফিভারের জীবানু উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া জাগুয়ার এবং অ্যানাকোন্ডা-ও অনেক সময় বিপদের কারন হতে পারে। তবে এ বন শুধু জীবজন্তু আর উদ্ভিদের জন্যই স্বর্গরাজ্য নয় বরং এখানে অনেক মনুষ্য বসতিও আছে। এই বনে ৪০০শ এর বেশী উপজাতি বাস করে। তারা বেশির ভাগ ব্রাজিলীয়। তারা পর্তুগীজ,স্প্যানিস ইত্যাদি ভাষায় কথা বলে।এছাড়াও এদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। এদের মধ্যে কিছু যাযাবর। হাজার বছর ধরে এখানে আদি ইনডিয়ানরা বসবাস করে আসছে। বর্তমানে এখানে বসবাসরত ইনডিয়ানের সংখ্য প্রায় ২ লাখ, এদের বহিঃবিশ্বের সাথে তেমন যোগাযোগ নেই।
আরো জানুন: পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ১০ টি জঙ্গল
আমাজন জঙ্গলের ১৫টি বিস্ময়কর তথ্যঃ
- আজ থেকে ১১ হাজার বছর আগে আমাজন জঙ্গলের আশে পাশে মানুষ বসতি স্থাপন করতে শুরু করে।
- একসময় হেনরি ফোর্ড নামক এক ব্যক্তি আমাজন জঙ্গলে রাবার চাষের উদ্দেশ্যে একটি ওয়ার্ক হাউজ তৈরি করেন যা এখন ফোরলান্ডিয়া পরিত্যাক্ত ভুতের বাড়ি হিসেবে পরিচিত।
- যদি পুরো আমাজন জঙ্গলকে একটি দেশ হিসেবে ধরা হয় তাহলে আমাজন পৃথিবীর ৭ম বৃহত্তম দেশ হবে।
- নিউইয়র্ক শহরে ১২ বছরে যত পানি ব্যবহৃত হয় আমাজন নদীতে তার চেয়েও বেশি পানি প্রবাহিত হয় একদিনে এবং গোটা পৃথিবীর পরিচ্ছন্ন পানির ২০ ভাগ বয়ে চলে এই নদীতে।
- আমাজন জঙ্গলকে পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয়ে থাকে কারন, এটি পৃথিবীতে মোট উৎপাদিত অক্সিজেনের ২০% একাই সরবরাহ করে।
- বিশ্বের মোট ঔষধের ২৫% কাঁচামাল আসে এ বনের মাত্র ৪০০ প্রজাতির গাছ থেকে।
- গড়ে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ৭৫,০০০ ধরনের বৃক্ষ পাওয়া যায়।
- আমাজন জঙ্গলে আছে ৩০০০ প্রকারের ফল। তবে খাওয়ার যোগ্য ফল আছে মাত্র ২০০ প্রকারের।
- সাহারা মরুভূমি থেকে প্রতি বছর ৪০ মিলিয়ন টন বালি উড়ে আসে আমাজনে!
- আমাজন জঙ্গলের বর্তমান আয়তন হলো ২.৬ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার। পূর্বে ছিল প্রায় ৬ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার। বন ধ্বংস এবং বাসস্থানের জন্য বন কাটায় আজ এর আয়তন এতো কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিজ্ঞানী আশংকা প্রকাশ করেছেন যে আমাজন অরণ্য আগামী ৫০ বছরের মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে পারে।
- গাছপালা নিধন এবং খনি খননের কাজের জন্য আমাজনে প্রতি সেকেন্ডে একটি ফুটবল মাঠের আয়তনের সমান জায়গা ধ্বংস করা হচ্ছে।
- মাঝে মাঝে আমাজনের কোনো জলাশয় বা বদ্ধ পানিতে এতো বেশি শাপলা জন্মে যে, সেখানে শাপলার একটা মেঝের মত তৈরি হয় যার উপর দিয়ে একটা ছোট বাচ্চা নির্দ্বিধায় হেঁটে যেতে পারবে।
- গাছপালাগুলো একেকটা একেকটার সাথে এমন ঘন ভাবে লাগানো যে এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি সবচেয়ে বড় গাছের শীর্ষ থেকে মাটিতে পৌঁছতে প্রায় ১০ মিনিট সময় নেয় (ব্যাপারটা পরিষ্কার করি, সবচেয়ে উঁচু গাছ থেকে তার চেয়ে ছোটটায় পড়ে, এভাবে আস্তে আস্তে মাটিতে আসে কিন্তু গাছের পরিমাণ এতই বেশি যে হয়তো এক ফোঁটা পানিকে প্রায় ৬০ টি গাছের পাতা পাড়ি দিয়ে মাটিতে পৌঁছতে হয়।
- আমাজন নদী থেকে এত পরিমাণে সুমিষ্ট পানি সমুদ্রে গিয়ে মেশে যে প্রায় ১০০ মাইল পর্যন্ত সমুদ্রের পানি কম লবণাক্ত থাকে এবং প্রতি সেকেন্ডে ৪.২ মিলিয়ন ঘন ফুট পানি নিয়ে ফেলে সাগরে।
- আমাজন জঙ্গলের গহিনে এমন জায়গাও রয়েছে যেখানে আজ পর্যন্ত মানুষের পা পড়েনি একটিবারের জন্যও এবং রয়েছে রহস্যময় এক ফুটন্ত নদী। এই রহস্যময় নদীর পানির তাপমাত্রা ৮৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস যা যে কোন প্রাণীর জন্য এক মৃত্যু ফাদ।
আজকের বিষয়টি (আমাজন রহস্য) ভালো লেগে থাকলে শেয়ার করুন আপনার বন্ধুদের সাথে। পৃথিবীর এরকম (জানা-অজানা) অদ্ভুত সব অজানা তথ্য জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।
এছাড়াও যদি আপনি নিয়মিত বিশ্বের ছোট ছোট অদ্ভুত, রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক বিষয় সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত থাকুন।
ফেইসবুক পেইজ:
ইউটিউব চ্যানেল:
ইনস্টাগ্রাম পেজ: The Earth Bangla
ফেইসবুক গ্রুপ:
প্রশ্নপর্ব
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রেইনফরেস্ট কোনটি?
দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদীর অববাহিকায় অবস্থিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রেইনফরেস্ট আমাজন।
এলডোরাডো নামক সত্যিই কি কোন সোনার শহর আছে?
অভিযাত্রীরা বিশ্বাস করত, বিশাল আমাজন বনের মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে আছে এলডোরাডো নামক এক গুপ্ত শহর যা পুরোপুরি সোনার তৈরি। এই ভ্রান্ত ধারনাটি এসেছে গ্রীক পৌরাণিক গল্প থেকে যেখানে বলা হয়েছে যে এলডোরাডো নামক সোনায় মোড়ানো শহরটি পাহাড়া দেয় এক শ্রেনীর বিশেষ নারীযোদ্ধারা যাদেরকে গল্পে আমাজন বলে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু কেউ এই কাল্পনিক শহরের সন্ধান না পেলেও স্থায়ী হয়ে যায় সেই নারী যোদ্ধাদের নাম। তাদের নামানুসারেই এই জঙ্গলের নাম হয় আমাজন জঙ্গল।
আমাজন জঙ্গলে কত প্রজাতির গাছ রয়েছে ?
এই বনে প্রায় ৩৯০ বিলিয়ন বৃক্ষ রয়েছে যেগুলো প্রায় ১৬০০০ প্রজাতিতে বিভক্ত। দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের মোট আয়তনের ৪০% এই বনের দখলে।
অ্যামাজন জঙ্গলে কারা বসবাস করে ?
আমাজন জঙ্গলে প্রায় ৪০০শ এর বেশী উপজাতি বাস করে। আজ থেকে ১১ হাজার বছর আগে এই বনের আশে পাশে মানুষ বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। হাজার বছর ধরে এখানে আদি ইনডিয়ানরা বসবাস করে আসছে। বর্তমানে এখানে বসবাসরত ইনডিয়ানের সংখ্য প্রায় ২ লাখ, এদের বহিঃবিশ্বের সাথে তেমন যোগাযোগ নেই।
আমাজন কে পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয়ে থাকে কেন?
আমাজনকে পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয়ে থাকে কারন, এটি পৃথিবীতে মোট উৎপাদিত অক্সিজেনের ২০% একাই সরবরাহ করে।
আমাজন জঙ্গলে কত প্রকারের ফল পাওয়া যায় ?
আমাজনে আছে ৩০০০ প্রকারের ফল। তবে খাওয়ার যোগ্য ফল আছে মাত্র ২০০ প্রকারের।
আমাজন জঙ্গলের আয়তন কত ?
আমাজনের বর্তমান আয়তন হলো ২.৬ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার। তবে পূর্বে এর আয়তন ছিল প্রায় ৬ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার। বন ধ্বংস এবং বাসস্থানের জন্য বন কাটায় আজ এর আয়তন এতো কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিজ্ঞানী আশংকা প্রকাশ করেছেন যে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে আমাজন অরণ্য আগামী ৫০ বছরের মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে পারে।
পুরো আমাজন জঙ্গল একটি দেশ হলে কি হবে ?
যদি পুরো আমাজন জঙ্গলকে একটি দেশ হিসেবে ধরা হয় তাহলে আমাজন পৃথিবীর ৭ম বৃহত্তম দেশ হবে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রেইন ফরেস্ট (Rain forest) এই আমাজন জঙ্গল। এই আলো-আঁধারি জঙ্গলে কোথায় যে বিপদ লুকিয়ে আছে তা কে জানে? একটু অসতর্ক হলেই প্রাণটা খোয়াতে হতে পারে কোনো বন্য জন্তুর আক্রমণে। জানেন কি সেই প্রাণীর নাম?
উত্তরমুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not Enter any spam comment or Link in the comment Box