পৃথিবীর বৃহত্তম ১০ টি বন

পৃথিবীতে মানবজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ন উপাদানগুলোর একটি হচ্ছে অক্সিজেন, যার মূল উৎস পৃথিবীর বিশাল সব জঙ্গল থেকে। বর্তমানে পৃথিবীর স্থলভাগের প্রায় ২০% অংশ জঙ্গল দিয়ে বেস্টিত। বিভিন্ন প্রজাতির মানুষের আবাস্থল এর পাশাপাশি, এই জঙ্গলে রয়েছে জানা অজানা হাজারো প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রানীর অস্তিত্ব। The Earth Bangla এর সেরা ১০ সিরিজের আজকের পর্বে আমরা জানাবো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও ভয়ঙ্কর ১০টি জঙ্গল সম্পর্কে।

১. তাইগা

তাইগা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বনাঞ্চল যা বিশ্বের মোট বনভূমির প্রায় ৩০ শতাংশ জায়গা দখল করে আছেএর আয়তন প্রায় ১৭ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার যা আলাস্কা থেকে শুরু করে কানাডা, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া এবং জাপানের উত্তরাংশ জুড়েও বিস্তৃত। প্রাকৃতিক পরিবর্তন এবং মহাদেশীয় সীমারেখার কারণে এই বন তিনটি অংশে বিভক্ত। তবে এই বনের অধিকাংশ অঞ্চল রাশিয়া ও কানাডাতে অবস্থিত। পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ বৃক্ষ তাইগা বনাঞ্চলে রয়েছে। যদিও ফার গাছের অপার সৌন্দর্যের কারনে তাইগা অনেক সুপরিচিত। বিশ্বের বনাঞ্চলসমূহের মধ্যে তাইগার তাপমাত্রা সর্বনিম্ন। শীতকালে এই বনাঞ্চলের তাপমাত্রা -৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যায় এবং এর উত্তরাঞ্চলে বছরের প্রায় ৯ মাস বরফে ঢাকা থাকে। কিন্তু এই প্রতিকূল অবস্থাতেও এই জঙ্গলে বিভিন্ন ধরনের প্রাণী, যেমন শিয়াল, নেকড়ে, ভাল্লুক ইত্যাদি বসবাস করে।

২. আমাজন রেইনফরেস্ট

দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদীর অববাহিকায় অবস্থিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রেইনফরেস্ট আমাজন জঙ্গল। আমাজন রেইনফরেস্ট আমাজন অরণ্য বা আমাজনিয়া নামেও পরিচিত। এর আয়তন প্রায় ৭ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার যার ৬০% ব্রাজিলে, ১৩% পেরুতে এবং বাকি অংশ রয়েছে কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গায়ানা, সুরিনাম এবং ফরাসি গায়ানাতে। দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের মোট আয়তনের ৪০% এই বনের দখলে। এই বনে প্রায় ৩৯০ বিলিয়ন বৃক্ষ রয়েছে যেগুলো প্রায় ১৬০০০ প্রজাতিতে বিভক্ত। এজন্য আমাজন জঙ্গলকে পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয়ে থাকে কারন, এই বনাঞ্চলটি পৃথিবীতে মোট উৎপাদিত অক্সিজেনের ২০% একাই সরবরাহ করে। এছাড়াও রয়েছে কিছু ক্ষতিকর প্রানি যেমন পিরানহা, রক্তচোষা বাদুর, বিষাক্ত ব্যাঙ, বৈদ্যুতিক মাছ, রেবিস, ম্যালেরিয়া, ইয়েলো ফিভার, ডেঙ্গু ফিভারের জীবানু উল্লেখযোগ্য। এখানকার প্রাণী বৈচিত্র্য অতুলনীয় এবং এখানকার ইকোসিস্টেম অত্যন্ত শক্তিশালী যা মিলিয়ন বছর ধরে টিকে আছে।

আরো জানুন: আমাজন জঙ্গল সম্পর্কে অদ্ভুত ১৫টি তথ্য

৩. কঙ্গো রেইনফরেস্ট

আমাজনের পরেই ৩য় স্থান দখল করে নিয়েছে আফ্রিকার কংগো রেইনফরেস্ট,যা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম রেইন ফরেস্ট। এর আয়তন প্রায় ৩ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার যা মধ্য আফ্রিকার দেশ আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, ক্যামেরুন, কংগো প্রজাতন্ত্র, গনতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কংগো, গ্যাবন এবং নিরিক্ষীয় গিনি এই ৬ টি দেশ জুড়ে বিস্তৃত। এই বনভূমির ভেতর দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ নদী কঙ্গো নদী। এছাড়া প্রায় ১০ হাজারের বেশি প্রজাতির প্রানী, ৬০০ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রায় ১ হাজারেরও বেশি প্রজাতির পাখিদের বসবাস রয়েছে এই বিশাল জঙ্গলে। পিগমি শিম্পাঞ্জি সারা পৃথিবীতে কেবল এখানেই দেখতে পাওয়া যায়। আমাজন বনের পরে এটিকে পৃথিবীর দ্বিতীয় ফুসফুস বলা হয়ে থাকে। এই বনভূমি তার অনন্য বৈচিত্র্যতার কারণে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্থান পেয়েছে।

৪. ভালদিভিয়ান টেম্পারেট রেইনফরেস্ট

ভালদিভিয়ান টেম্পারেট রেইনফরেস্ট দক্ষিণ আমেরিকায় অবস্থিত নাতিশীতোষ্ণ একটি জঙ্গল। এর আয়তন প্রায় ২৪৮,১০০ বর্গকিলোমিটার যা চিলি ও আর্জেন্টিনার বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এই বনভূমিতে প্রায় ৯০ শতাংশ উদ্ভিদই স্থানীয় প্রজাতির যার মানে হলো এই প্রজাতির গাছগুলো পৃথিবীর অন্য কোন বনাঞ্চলে দেখা যায় না। সবুজ অরন্যে আবৃত এই জঙ্গলটি বেশিরভাগ সময়ই কুয়াশায় ঘেরা থাকে এবং এটিই পৃথিবীর একমাত্র রেইনফরেস্ট যা হিমবাহ নিয়ে গঠিত। এছাড়াও চিলির জাতীয় ফুল কোপিহু, হামিং বার্ড পাখি, পৃথিবীর সব থেকে ক্ষুদ্রতম বিড়াল (কোডকোড) এবং ক্ষুদ্রতম হরিন (দিক্ষিনী পুডু) এর পদচারনা দেখা যায় এই বনভূমিতে।

৫. টঙ্গাস ন্যাশনাল ফরেস্ট

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা প্রদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এই টঙ্গাস ন্যাশনাল ফরেস্ট। এটি আমেরিকার সবথেকে বড় ন্যাশনাল ফরেস্ট যার আয়তন প্রায় ৬৯,০০০ বর্গকিলোমিটার। এটি উত্তর আমেরিকার বৃহত্তম নাতিশীতোষ্ণ বন। টংগাস ন্যাশনাল ফরেস্ট মুলত একটি নাতিশীতঞ্চ রেইনফরেস্ট যা একইসাথে আলেকজান্ডার দ্বীপপুঞ্জ এবং কোস্ট পর্বতমালার হিমবাহ নিয়ে গঠিত। এই জঙ্গলটি অত্যন্ত দুর্গম হওয়ার কারণে বিভিন্ন প্রজাতির বিপন্নপ্রায় বৃক্ষ ও প্রাণীদের অভয়ারণ্য। বিভিন্ন প্রজাতির বাদামী ভাল্লুক, কালো ভালুক, ছাগল, হ্যাম্পব্যাক তিমি, টাক ঈগল, নেকড়ে ইত্যাদি প্রাণীদের বিশাল এক আবাসস্থল এই বনভূমি।

আরো জানুন: বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০টি মরুভূম

৬. জিশুয়াংবান্না রেইনফরেস্ট

জিশুয়াংবান্না রেইনফরেস্ট দক্ষিণ চীনের ইউনান প্রদেশে অবস্থিত একটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় রেইনফরেস্ট। এটি এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম রেইনফরেস্ট যার আয়তন প্রায় ১৯,২২৩ বর্গ কিলোমিটার। এই বনভূমিটি চীনের মোট উদ্ভিদ বৈচিত্র্য এর ১৬% নিয়ে গঠিত এবং এই জঙ্গলে প্রায় ৫ হাজার প্রজাতির ভাস্কুলার উদ্ভিদ রয়েছে। এই রেইনফরেস্টটি চিনের বাস্তুতন্ত্রের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কারণ এখানে চীনের বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ এবং উভচর প্রাণীর বসবাস রয়েছে। এছাড়াও এশিয়ান হাতি, ইন্দো-চীনা বাঘ এবং সবুজ ময়ূরের বিচরণ দেখা যায় এই অরণ্য ভূমিতে।

৭. সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট হল সুন্দরবন। বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকায় প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের ৬০% বাংলাদেশে এবং ৪০% ভারতে অবস্থিত।  এই বনের ৩১.১% জুড়ে রয়েছে নদী-নালা, খাল-বিল জনাকীর্ণ অঞ্চল। এই বনের প্রধান গাছ সুন্দরী, গরান, গেওয়া, গোলপাতা ও কেওড়া। 

এছাড়াও এখানে ২৯০ প্রজাতির পাখি, ১২০ প্রজাতির মাছ, ৪২ স্তন্যপায়ী প্রজাতি, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮টি উভচর প্রজাতি বাস করে। সুন্দরবনে রয়েছে পৃথিবীর অন্যতম বিরল বাঘের একটি প্রজাতি যার নাম রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এই বাঘের গর্জন প্রায় ৩ কিলোমিটার দূর থেকে শুনতে পাওয়া যায়। তাছাড়াও রয়েছে বিচিত্র পাখপাখালি, চিত্রা হরিণ, কুমির, সাপ সহ প্রভৃতি প্রাণির আবাসস্থল। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

৮. ডেইন্ট্রি রেইনফরেস্ট

প্রায় ১৮০ মিলিয়ন বছর পুরনো এই ডেইনট্রি রেইনফরেস্ট বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন বনের মধ্যে একটি যার অবস্থান অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড এর উত্তর পূর্ব উপকূলে। এর আয়তন প্রায় ১২০০ বর্গকিলোমিটার যা অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় নিরবচ্ছিন্ন গ্রীষ্মমন্ডলীয় রেইনফরেস্ট। ডেইনট্রি রেইনফরেস্ট তার সুন্দর বৃক্ষের ছাউনি, লতাগুল্ম, প্রাচীন বনভূমি, পর্বত এবং উপত্যকার জন্য অধিক পরিচিত। পৃথিবীতে যতগুলো প্রাচীন বৃক্ষের অস্তিত্ব রয়েছে তাদের সন্ধান মিলে এখানেই। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়ার বাদুড় এবং প্রজাপতির অর্ধেক প্রজাতি এখানে পাওয়া যায়। এটি শুধুমাত্র বিশ্বের বৃহত্তম বনগুলির মধ্যে একটি নয়, এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র কারণ এটিকে তার ইতিহাস ও সৌন্দর্যের জন্য ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

আরো জানুন: পৃথিবীর নতুন সপ্তম আশ্চর্য

৯. কিনাবালু ন্যাশনাল পার্ক

কিনাবালু মালয়েশিয়ার সর্বপ্রথম জাতীয় উদ্যান যা মালয়েশিয়ার বোর্নিও দ্বীপে অবস্থিত। এর আয়তন প্রায় ৭৫৪ বর্গকিলোমিটার এবং এটিই মালয়েশিয়ার প্রথম ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত স্থান। এই বনাঞ্চলে ৪৫০০ এরও বেশি প্রজাতির গাছ রয়েছে যার মধ্যে ১০০০ প্রজাতির অর্কিড। এছাড়াও প্রাণীদের মধ্যে ৩২৬ প্রজাতির পাখি, ১০০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী এবং ১১ প্রজাতির শামুক।  কিনাবালু ন্যাশনাল পার্ক মূলত একটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় রেইনফরেস্ট যা এশিয়ার সবচেয়ে পুরনো ইকোসিস্টেমের অংশ। বর্তমানে মালয়েশিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পট এই পার্কটি।

১০. সিনহারাজা ফরেস্ট

সিনহারাজা বনভূমি বিশ্বের বৃহত্তম বনগুলির মধ্যে অন্যতম একটি যার আয়তন প্রায় ১১২ বর্গ কিলোমিটার। এটি মূলত শ্রীলংকায় অবস্থিত সংরক্ষিত একটি বন যা আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং ইউনেস্কো দ্বারা স্বীকৃত একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। এটি ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং শ্রীলংকার বন সংরক্ষণ বিভাগ দ্বারা পরিচালিত হয়। এই বনের ৬০ শতাংশ বৃক্ষ সম্পূর্ণ স্থানীয় এবং বেশির ভাগই দুর্লভ বলে বিবেচনা করা হয়। এই ঘন সবুজ উদ্ভিদের পাশাপাশি দেখা মেলে বিভিন্ন প্রজাতির উভচর প্রাণী, কীট-পতঙ্গ, সরীসৃপ সেইসাথে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। তাই সিনহারাজা ফরেস্ট শ্রীলংকার জাতীয় উদ্যান এবং জীব বৈচিত্র্যের হটস্পট হিসেবে পরিচিত।

তো এই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ১০ টি জঙ্গলের তালিকা। আজকের মতো আর কোন কোন বিষয়ের উপর এরকম তালিকা দেখতে চান তা আমাদের অবশ্যই কমেন্ট করে জানান। আজকের বিষয়টি (সেরা ১০) ভালো লেগে থাকলে শেয়ার করুন আপনার বন্ধুদের সাথে। পৃথিবীর এরকম (জানা-অজানা) অদ্ভুত সব অজানা তথ্য জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।

এছাড়াও যদি আপনি নিয়মিত বিশ্বের ছোট ছোট অদ্ভুত, রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক বিষয় সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত থাকুন।

ফেইসবুক পেইজ: The Earth Bangla

ইউটিউব চ্যানেল: The Earth Bangla

ইনস্টাগ্রাম পেজ: The Earth Bangla

ফেইসবুক গ্রুপ: The Earth Bangla Family

Post a Comment

Please do not Enter any spam comment or Link in the comment Box

নবীনতর পূর্বতন