কাতার দেশ সম্পর্কে তথ্য
কাতার মধ্য প্রাচ্যের আরব দেশ গুলির মধ্যে সবচেয়ে ছোট দেশ যা পারস্য উপসাগরের উপকূলে অবস্থিত। কাতারের দক্ষিণে সৌদি আরব এবং পশ্চিমে দ্বীপরাষ্ট্র বাহরাইন অবস্থিত। আরব উপদ্বীপের মত কাতারও একটি উত্তপ্ত ও শুষ্ক মরু এলাকা। তবে কাতার অর্থনৈতিকভাবে খুবই সমৃদ্ধশালী। পৃথিবীর তৃতীয় প্রাকৃতিক তেল এবং গ্যাস সমৃদ্ধ দেশ কাতার। মধ্যপ্রাচ্যে কাতারের অন্যতম সহযোগী দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মিশরের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর থেকে দেশটি মধ্যপ্রাচ্যের আলোচনার মূল বিন্দুতে চলে আসে। The Earth Banglar দেশ দেশান্তর সিরিজের আজকের পর্বে আমরা আপনাদের জানাবো কাতার দেশ সম্পর্কে।
কাতারের ইতিহাস
কাতার রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা শেখ জসিম বিন মোহাম্মদ আল থানি। একসময় কাতার তুরস্কের অটোমান সাম্রাটের শাসনাধীনে ছিলো। ১৯শ শতকের শেষভাগ থেকে আল থানি গোত্রের লোকেরা কাতার অঞ্চলটিকে একটি আমিরাত হিসেবে শাসন করে আসছিল। পরবর্তীতে মোহাম্মদ বিন থানি ব্রিটিশদের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত করেন যার ফলে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে কাতার ব্রিটিশ শাসনের অধীনে চলে আসে। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে দেশটি পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। প্রায় ১৫০ বছরের ইতিহাসে আজও কাতার থানী পরিবার দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে। বিংশ শতাব্দীতেও কাতারের সাধারণ মানুষের জীবিকা ছিলো একমাত্র মাছ ধরা তাই বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত এটি একটি দরিদ্র দেশ ছিল। ১৯৪০ সালে প্রথম "দুখান" তেলকুপ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি অর্জন করতে শুরু করে। বর্তমানে মাথাপিছু আয়ের হিসেবে কাতার বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলির একটি।
আরো জানুন: আর্জেন্টিনা দেশ সম্পর্কে
কাতার দেশ পরিচিতি
- অফিসিয়াল নাম: The state of Qatar
- আয়তন: ১১,৫৮ বর্গ কিলোমিটার (পৃথিবীতে ১৫৮ তম)
- জনসংখ্যা: প্রায় ২৮ লাখ। (পৃথিবীতে ১৩৯ তম, জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি কিলোমিটারে ২৪৮ জন)
- স্বাধীনতা অর্জন: কাতার ১৯৭১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
- সরকার পদ্ধতি: আধা-সাংবিধানিক ও রাজতান্ত্রিক
- জাতীয়তা: কাতারি
- রাষ্ট্র প্রধান: আমির
- রাজধানী: দোহা (সবচেয়ে বড় ও জনবহুল শহর)
- বড় শহর: দোহা, খোর, উমম বাব, আবু সামরা, আদ দোওহা ইত্যাদি।
- ধর্ম: ৬৫.৫℅ মুসলিম, ১৫.১% হিন্দু, ১৪.২% খ্রিস্টান, ৩.৩% বৌদ্ধধর্ম, ১.৯% অন্যান্য। (অফিশিয়ালি ধর্ম হচ্ছে ইসলাম)
- সময়: কাতারের সময় থেকে বাংলাদেশের সময়ের ব্যবধান ৩ ঘন্টা। অর্থাৎ কাতারে দুপুর ১২ টা বাজলে, বাংলাদেশে তখন বিকাল ৩ টা বাজে।
- ভাষা: কাতারের সরকারি ভাষা হচ্ছে, আরবি। দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও বাংলা, হিন্দি, উর্দূ, নেপালি, ফার্সি সহ আরো অন্যান্য ভাষা প্রচলিত রয়েছে।
- আবহাওয়া: উত্তপ্ত ও শুষ্ক (সর্বনিম্ন ১৩° থেকে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৫০° সেলসিয়াস।)
- মুদ্রা: কাতারি রিয়াল (বাংলাদেশী মুদ্রায় ২৭.৬৮ টাকা এবং ভারতীয় মুদ্রায় ২২.৫২ রুপি)
- শিক্ষার হার: ৯৭%
- গড় আয়ু: পুরুষ ৭৭, মহিলা ৮১
- মাথাপিছু আয়: ৯৩,৫০৮ মার্কিন ডলার (পৃথিবীতে চতুর্থ)
- জনপ্রিয় খেলা: ফুটবল
- ডায়ালিং কোড: +৯৭৪
- ডোমেইন সংকেত: .qa
কাতার সম্পর্কে অজানা তথ্য
- কাতার বিশ্বের অনেক দেশে তাদের সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে যা আন্তর্জাতিকভাবে কাতারকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে কাতার বিমান পরিবহণ সংস্থা "কাতার এয়ারলাইন্স" অন্যতম। এটি বিশ্বের সেরা বিমান সংস্থার মধ্যে একটি এবং এখন পর্যন্ত ৭ বার বিশ্বের সেরা বিমান সংস্থার খেতাব পেয়েছে।
- কাতারে কোন পাহাড় নেই। বিশ্বের সবচেয়ে সমতল দেশের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে কাতার (প্রথম মালদ্বীপ)। এদেশের উঁচু জায়গা গুলোর গড় উচ্চতা ৯১.৯ ফুট এবং সর্বোচ্চ উচ্চতা ৩৩৮ ফুট। এছাড়াও কাতার সম্পূর্ণরূপে একটি মরুভূমির দেশ হওয়ায় সেখানকার ৯৯% মানুষই শহরে বসবাস করে যার মধ্যে কাতারের রাজধানী দোহাতেই দেশটির প্রায় ৯০% এরও বেশি জনসংখ্যা বসবাস করে
- কাতার হল প্রথম আরব দেশ যেখানে ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়েছে। ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে এই ইভেন্টটি শুরু হয়। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ব্রাজিল ও রাশিয়া বিশ্বকাপে একত্রে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয়েছে, ২০২২ সালের বিশ্বকাপে কাতার একাই তার ১৫ গুণ বেশি খরচ করেছে। কেননা কাতারের আবহাওয়া অত্যন্ত উষ্ণ তাই প্রতিটি স্টেডিয়াম এয়ারকন্ডিশন দ্বারা ঘেরা হয়েছে।
- কাতার এমন একটি দেশ যেখানে সমুদ্র মরুভূমির সাথে মিলিত হয়। সমুদ্র-মরুভূমি মিলিত হওয়া এই অদ্ভুত জায়গাটির নাম খোর আল-আদাইদ। ২০০৭ সালে এই জায়গাটিকে একটি প্রাকৃতিক সংরক্ষণাগার হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
- কাতারে জনসংখ্যায় নারীর চেয়ে পুরুষের সংখ্যা অনেক বেশি। দেশটির মোট জনসংখ্যা ২৫ লাখের মতো কিন্তু এর মধ্যে নারীর সংখ্যা সাত লাখের কম। অর্থাৎ দেশটির মোট জনসংখ্যার মাত্র ২৫ % হলো নারী এবং ৭৫% হলো পুরুষ।
- কাতারের জনসংখ্যার ব্যাপারে আরেকটি অবাক করার মতো তথ্য হলো, দেশটির মোট জনসংখ্যার মাত্র ১২% মানুষ কাতারি এবং বাকি ৮৮% হলো বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষ যারা বিভিন্ন কাজে এদেশে এসেছে । বিদেশি এই অভিবাসীদের বেশিরভাগই ভারত, বাংলাদেশ এবং নেপালের। এছাড়াও পৃথিবীর মধ্যে কাতারই এক মাত্র দেশ যেখানে প্রায় ১৫০টি দেশেরও বেশি লোক বসবাস করে।
- কাতার বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশের তালিকায় চতুর্থ স্থানে রয়েছে। সিঙ্গাপুরের পর কাতারে সবচেয়ে বেশি কোটিপতি মানুষদের বসবাস করে। আপনি জেনে অবাক হবেন যে সেখানে প্রায় ১৩ শতাংশ লোক কোটিপতি। বর্তমানে দেশটির মাথাপিছু আয় ৯৩,৫০৮ মার্কিন ডলার যা দেশটিতে থাকা বিশাল তেল ও গ্যাসের মজুতের কারণে সম্ভব হয়েছে।
- কাতার এমন একটি দেশ যেখানে কোনো গরিব নেই এবং দেশটিতে বেকারত্বের হার মাত্র ০.১% অর্থাৎ নেই বললেই চলে। সেখানকার কোনো মানুষের থেকে সরকার কোনো ট্যাক্স নেয় না। এছাড়া সেখানে বিদ্যুৎ পরিষেবা, চিকিৎসা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রদান করা হয়।
- মুসলিম বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার মূলত কাতারের মালিকাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। তবে কাতারের আইন অনুযায়ী কোন সংবাদমাধ্যম থানি পরিবার এবং আমিরের বিরুদ্ধে কোন সংবাদ প্রচার করতে পারবে না। এছাড়া খেলাধুলার চ্যানেল beIN SPORTS প্রতিষ্ঠানটিও কাতারের যার পূর্ব নাম ছিল আলজাজিরা স্পোর্টস।
- পৃথিবীতে বনভূমি নেই এমন চারটি দেশের মধ্যে কাতার একটি। বাকি তিনটি হলো ওমান সান মারিনো ও গ্রিনল্যান্ড। কাতারের শুষ্ক জমি এবং জলাশয় না থাকায় সেখানে মাত্র ১% এর ও কম জমিতে কৃষিকাজ করা হয় তাই ৯০% এর বেশি খাবার বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ফলে কাতারে খাবারের দাম অন্যান্য দেশের তুলনায় একটু বেশি। তবে কাতারে ১ লিটার পেট্রোলের দাম একটি বার্গার থেকেও কম। অর্থাৎ কাতারে ১ লিটার পেট্রোলের দাম মাত্র ৩৫ টাকা যেখানে একটি বার্গারের দাম ৩০০ টাকাও বেশি।
- কাতারে দুই ধরণের আইন দেখতে পাওয়া যায়। একটা হলো সাধারণ আইন এবং আরেকটি হলো শরিয়া আইন। কাতার একটি ইসলামিক রাষ্ট্র হওয়ায় সেখানে কিছু নিয়ম রয়েছে যা সবাইকে মেনে চলতে হয়। যেমন সেখানে মেয়েদের ছোট পোশাক পড়া, মদ বেচাকেনা, পাবলিক প্লেসে মদ্যপান ও পর্নোগ্রাফি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। শরিয়া আইন সাধারণ আইনে তুলনায় অত্যন্ত কঠোর এবং এই আইনে কেউ ধর্ম অবমাননা করলে ৭ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
- ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে কাতার অত্যন্ত নিরাপদ একটি দেশ যেখানে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, হারিকেন, টর্নেডো, ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিকম্পের মত কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি নেই।
- মুসলিম দেশ হওয়ায় কাতারে সাপ্তাহিক ছুটির দিন হল শুক্রবার এবং শনিবার যা পশ্চিমা দেশগুলোর নিয়মের থেকে একেবারেই আলাদা। ইসলামে শুক্রবারকে একটি পবিত্র দিন হিসেবে গণ্য করা হয়। তাই এই দিন কাতারে সাপ্তাহিক ছুটি থাকে।
- বিগত প্রায় ১৫০ বছর ধরে আল থানি পরিবার কাতার শাসন করে আসছে। ১৮৬৮ সালে এই পরিবারটি কাতারের মূল ক্ষমতায় আসে এবং বংশ পরম্পরায় এই পরিবার থেকেই কাতারের আমির নির্বাচন করা হয়।
- আপনি জানলে অবাক হবেন যে, লন্ডনের বেশিরভাগ সম্পত্তির মালিক হল কাতার! পুরো বিশ্বজুড়ে কাতারের বিভিন্ন দেশের রিয়েল এস্টেট ও বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগ রয়েছে, তবে তার বেশিরভাগ বিনিয়োগ হল লন্ডনে। বর্তমানে ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের চেয়ে কাতারের রাজপরিবার লন্ডনে বেশি সম্পত্তির মালিক।
- কাতারে উটের দৌড় প্রতিযোগিতা ব্যাপক জনপ্রিয়। মজার বিষয় হল, এই প্রতিযোগিতাতে জকি হিসেবে ব্যবহার করা হয় আধুনিক রোবট। এছাড়াও কাতারের রাজধানী দোহাতে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম নিরবিচ্ছিন্ন সাইকেল চালানোর রাস্তা। প্রায় ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রাস্তাটি গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডেও নাম লিখিয়েছে।
- পৃথিবীতে মোট ১১৫৪টি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মধ্যে কাতারে শুধুমাত্র একটি ইউনেস্কো স্বীকৃত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট রয়েছে যার নাম হল আল জুবারাহ। এটি একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন দুর্গ।
- ১৯৪০ সালের আগে কাতারের অর্থনীতি সামুদ্রিক মাছ এবং মুক্তা আহরণের উপর নির্ভর ছিল। সেসময় কাতার বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে একটি ছিল। ১৯৩৯ সালে সর্বপ্রথম কাতারে তেলের খনি আবিষ্কৃত হয় এবং ৮০’র দশকে কাতার গ্যাসের মজুদ খুঁজে পায়। এরপর থেকে তেল ও গ্যাসের বাণিজ্য হয়ে ওঠে দেশটির অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। ফলে কাতার হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।
- বিশ্বের সবচেয়ে জাতিগত বৈষম্যকারী দেশগুলোর মধ্যে কাতার উল্লেখযোগ্য। একই সাথে দেশটিতে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটে যাচ্ছে সেদেশে আসা শ্রমিকদের সাথে যা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বহুবার বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছে।
- পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট দেশ হিসেবে কাতার ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করেছে। এই বিশ্বকাপ কে কেন্দ্র করে কাতার ১২টি নতুন স্টেডিয়াম তৈরির কাজ শুরু করে যেখানে কাজ করতে গিয়ে প্রায় ৬৫০০ এরও বেশি শ্রমিক নিহত হয়েছে এবং গুরুতরভাবে আহত হয়েছে আরো কয়েক হাজার শ্রমিক।
এই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ কাতার সম্পর্কে জানা অজানা ও অবাক করার মত কিছু তথ্য। এছাড়াও আর কোন দেশের উপর এরকম তথ্য জানতে চান তা আমাদের অবশ্যই কমেন্ট করে জানান। পৃথিবীর এরকম (দেশ দেশান্তর) সব অজানা তথ্য জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।
এছাড়াও যদি আপনি নিয়মিত বিশ্বের ছোট ছোট অদ্ভুত, রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক বিষয় সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত থাকুন।
ফেইসবুক পেইজ:
ইউটিউব চ্যানেল:
ইনস্টাগ্রাম পেজ: The Earth Bangla
ফেইসবুক গ্রুপ:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not Enter any spam comment or Link in the comment Box