পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ১০টি ভাষা

সৃষ্টির শুরু থেকে মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য মানুষ কতই না উপায় আবিষ্কার করেছে। কখনো ইশারায়, কখনো ছবি এঁকে আরো না জানি কতো উপায়ে তারা মনের ভাব প্রকাশ করতো। কিন্তু এ সকল উপায়ের মাঝে যেই উপায়টি সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে তা হল ভাষা। আজ আমাদের পৃথিবীতে ৫০০০ এর ও বেশি ভাষা প্রচলিত রয়েছে। এর মধ্যে কোন ভাষাটি সবচেয়ে প্রাচীন তা নিয়ে ভাষাবিদগণদের মধ্যে রয়েছে নানান ধরনের বিতর্ক। তবে কিছু এমন ভাষা রয়েছে যে ভাষাগুলোকে বিশ্বের প্রায় সকল ভাষাবিদগণ সর্বপ্রাচীন ভাষাসমূহের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। The Earth Banglar সেরা ১০ সিরিজের আজকের পর্বে আমরা আপনাদের জানাবো বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ১০টি ভাষা সম্পর্কে।

১০. মিশরীয় ভাষা

মিশরীয় ভাষাকে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ভাষা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ধারনা করা হয়, এ ভাষার ইতিহাস প্রায় ৫০০০ বছরের পুরনো। প্রাচীন মিশরে মূলত তিন ধরনের লেখা প্রচলিত ছিলো। এগুলো হল হায়ারোগ্লিফস, হায়রাটিক এবং ডেমোটিক। হায়ারোগ্লিফস থেকে বিবর্তিত হয়ে হায়রাটিক এবং হায়রাটিক থেকে বিবর্তিত হয়ে ডেমোটিক ভাষা উদ্ভাবিত হয়েছে। প্রাচীন মিশরের হায়ারোগ্লিফস হল এমন একটি ভাষা যে ভাষায় নানান ধরনের চিত্র অঙ্কন করা হতো। বর্তমানে খুব কম সংখ্যক মানুষ মিশরীয় ভাষাকে তাদের প্রথম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেন।

৯. লিথুয়ানীয় ভাষা

ইউরোপের বেশিরভাগ ভাষার মত লিথুয়ানীয় ভাষাও মুলত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা থেকেই এসেছে। কিন্তু ইউরোপের বেশিরভাগ ভাষাই কালের পরিক্রমে পূর্বের সময়কার তুলনায় ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে লিথুয়ানীয় ভাষা ব্যতিক্রম। কারণ এই ভাষা এখনো তার পূর্বপুরুষদের ভাষাগত বৈশিষ্ট্য অনেকাংশে ধরে রেখেছে। ধারনা করা হয়, এই ভাষা খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দের দিকে উদ্ভাবিত হয়েছিল। লিথুয়ানীয় ভাষা ল্যাটিন বর্ণমালায় লেখা হয়। এই ভাষা লিথুয়ানিয়া দেশের রাষ্ট্রভাষা। পাশাপাশি এই ভাষা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম একটি সরকারি ভাষা। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৩ মিলিয়নের বেশি মানুষ এই ভাষায় কথা বলে।

আরো জানুন: বিশ্বের প্রাচীনতম ১০টি মসজিদ

৮. গ্রিক ভাষা

গ্রিক ভাষা পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো ভাষাগুলোর মধ্যে একটি। এই ভাষার প্রথম যে নিদর্শনটি পাওয়া গিয়েছিল তা আজ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৫০ সাল পুরনো বলে ধারনা করা হয়। তবে অনেক ভাষাবিদরাই মনে করেন যে, এই ভাষা সর্বপ্রথম খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ সালের দিকে এসেছিল। বর্তমানে এই ভাষা গ্রিক এবং সাইপ্রাস দেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত রয়েছে। বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৩ মিলিয়নের বেশি মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। একসময় পৃথিবীর বেশিরভাগ বিজ্ঞানী, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ এবং পণ্ডিতরা এই ভাষাতেই পড়াশোনা করতেন। এছাড়া গ্রিক ভাষা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম একটি সরকারী ভাষা।

৭. ল্যাটিন ভাষা

ল্যাটিন ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা থেকে এসেছে। প্রাচীনকালে ল্যাটিন ভাষা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হতো। ধারনা করা হয়, ৭৫ বি.সি তে এই ভাষা উদ্ভাবিত হয়েছে। এই ভাষাকে ইউরোপের অনেক ভাষার মূল উৎস হিসেবে মনে করা হয়। ল্যাটিন ভাষাকে বর্তমানে একটি মৃত ভাষা বা Dead language নামে আখ্যায়িত করা হয়। কারন বর্তমানে পৃথিবীর কোন মানুষই এই ভাষাকে তাদের প্রথম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেনা। তবে পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাসকে জানতে এবং প্রাচীন সময়কার মানুষদের লেখাগুলো পড়ার জন্য অনেকেই এই ভাষা শেখেন। ল্যাটিন ভাষা সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, পৃথিবীর অধিকাংশ প্রাণী ও উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নাম ল্যাটিন ভাষার ওপর ভিত্তি নামকরন করা হয়েছে

৬. ফার্সি ভাষা

ফার্সি ভাষা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ভাষা যা ‘পার্সিয়ান ভাষা’ নামেও পরিচিত। ধারনা করা হয়, আধুনিক ফার্সি ভাষা ৮০০ সি.ই এর কাছাকাছি সময়ের দিকে বিস্তৃতি লাভ করেছে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় ১১০ মিলিয়ন মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। ফার্সি ভাষা বর্তমানে মোট ৩ টি দেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত রয়েছে। আফগানিস্তানে এই ভাষাকে ‘দারি’, ইরানে ‘পার্সিয়ান’ এবং তাজিকিস্তানে এই ভাষাকে তাজিক নামে অভিহিত করা হয়। পাকিস্তানের উর্দু ভাষা মূলত এই ফার্সি ভাষা দ্বারা অনেকাংশে প্রভাবিত হয়েছে।

আরো জানুন: বিশ্বের নতুন সপ্তম আশ্চর্য

৫. হিব্রু ভাষা

হিব্রু ভাষা হল বিশ্বের সকল ইহুদিদের জন্য পবিত্র একটি ভাষা। এই ভাষার ইতিহাস প্রায় ৩০০০ বছরেরও বেশি পুরনো। ইহুদিদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ তোরাহ হিব্রু ভাষাতে লেখা রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৯ মিলিয়ন মানুষ হিব্রু ভাষায় কথা বলে। হিব্রু ভাষার ইতিহাস কিছুটা বৈচিত্র্যময়। কেননা ২০০ থেকে ৪০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই ভাষা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। শুধুমাত্র এই ভাষার লিখিত রুপ সেসময় টিকে ছিল। এরপর আবার ১৯শ শতকের শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এই ভাষার কথ্য ভাষা হিসেবে পুনর্জন্ম হয় এবং হিব্রু ভাষা ইসরায়েল এর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

৪. সংস্কৃত ভাষা

সংস্কৃত ভাষা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ভাষা। এই ভাষাটি হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের অনুসারীদের জন্য একটি পবিত্র ভাষা। সংস্কৃত ভাষার ইতিহাস ৩৫০০ বছরেরও বেশি পুরনো। তবে এখন পর্যন্ত এই ভাষার সবচেয়ে প্রাচীন যে নিদর্শনটি পাওয়া গিয়েছে তা খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে রচিত হয়েছিল। হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র দুইটি গ্রন্থ গীতা এবং মহাভারত সংস্কৃত ভাষাতেই লেখা। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। সংস্কৃত ভাষা পৃথিবীর কোন দেশেরই রাষ্ট্রভাষা নয় তবুও এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এই ভাষায় কথা বলা সবচেয়ে বেশি মানুষ ভারতেই পাওয়া যাবে। আমাদের বাংলা ভাষা সংস্কৃত ভাষা থেকেই এসেছে

৩. তামিল ভাষা 

তামিল ভাষা পৃথিবীর অন্যতম ক্লাসিকাল একটি ভাষা। তামিল ভাষা মূলত প্রাচীন দ্রাবিড় ভাষা থেকে এসেছে। এই ভাষার লিখিত রুপ এখন পর্যন্ত খুবই কম পরিবর্তিত হয়েছে। ভাষাবিদদের মতে, তামিল ভাষার ইতিহাস প্রায় ২০০০ বছরেরও বেশি পুরনো। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৮ কোটি মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। তামিল ভাষা সিঙ্গাপুর এবং শ্রীলঙ্কার অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। এছাড়া ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে এবং মালয়েশিয়াতে এই ভাষায় কথা বলতে পারা অসংখ্য মানুষ রয়েছে। ভারতে এখন পর্যন্ত যত প্রাচীন সময়কার খোদাই করা লিপি এবং প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী পাওয়া গিয়েছে তার অর্ধেকেরও বেশি তামিল ভাষায় লেখা।

আরো জানুন: বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০টি ধর্ম

২. চীনা ভাষা

বর্তমানে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষ যেই ভাষায় কথা বলে তা হল চীনা ভাষা। ধারনা করা হয়, এই ভাষা ১২৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে অধিক জনপ্রিয় হতে শুরু করেছিল। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১.৩ বিলিয়ন মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। বিশ্বের মাত্র ৫ টি দেশে চীনা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত রয়েছে। এই ভাষাতে প্রায় ১০০০ এরও বেশি বর্ণ রয়েছে। ১৯৬২ সালে চিনের ইয়াংশাও কালচারের সময়কালীন কিছু লেখা পাওয়া গিয়েছিল। এই লেখাটি ইতিমধ্যে পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন লেখা হিসেবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম লিখিয়ে নিয়েছে। বর্তমানে চীনা ভাষার অসংখ্য উপভাষা রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে থেকে ম্যান্ডারিন চাইনিজ এবং ক্যান্টোনিজ চাইনিজ সবচেয়ে বেশি প্রচলিত।

১. আরবি ভাষা

আরবি ভাষা বিশ্বের সকল মুসলিমদের জন্য একটি পবিত্র ভাষা। ধারনা করা হয়, আরবি ভাষার প্রচলন শুরু হয়েছিল লৌহযুগ থেকে। কিছু কিছু সূত্রানুযায়ী, এই ভাষার প্রথম নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল ৫১২ সি-ই তে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৪২২ মিলিয়ন মানুষ আরবি ভাষায় কথা বলে এবং বিশ্বের ২৭ টি দেশে আরবি ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত রয়েছে। আরবি ভাষা ডান দিক থেকে বাম দিকে লেখা হয় এবং এই ভাষায় মোট ২৯ টি হরফ বা বর্ণ রয়েছে। আরবি ভাষার এই ব্যাপক প্রচলনের পেছনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ আল-কোরান। কারন কোরান এর প্রতিটি আয়াত আরবি ভাষাতে লেখা।

এছাড়াও যদি আপনি নিয়মিত বিশ্বের ছোট ছোট অদ্ভুত, রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক বিষয় সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত থাকুন।

ফেইসবুক পেইজ: The Earth Bangla

ইউটিউব চ্যানেল: The Earth Bangla

ইনস্টাগ্রাম পেজ: The Earth Bangla

ফেইসবুক গ্রুপ: The Earth Bangla Family

Post a Comment

Please do not Enter any spam comment or Link in the comment Box

নবীনতর পূর্বতন