যে ১০টি দেশ ভারতকে ঘৃণা করে
বর্তমানে ভারত একটি উদীয়মান অর্থনীতি যা তথ্য প্রযুক্তি, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং উৎপাদনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাই দেশটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে সব সময় শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলে এবং ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আন্তরিক। কিন্তু বিশ্বে এমন কিছু দেশ রয়েছে যাদের সাথে ভারতের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মতবিরোধ রয়েছে এবং সেই দেশগুলোকে ভারতের শত্রু দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়াও ভারতের কিছু প্রতিবেশী দেশ রয়েছে যাদের সাথে ভারতের দ্বন্দ্ব রয়েছে যার ফলে তারা ভারতকে তাদের শত্রু দেশ মনে করে। The Earth Banglar সেরা ১০ সিরিজের আজকের পর্বে আমরা আপনাদের জানাবো ভারতের শত্রু ১০টি দেশ সম্পর্কে।
১০. সৌদি আরব
ভারত ও সৌদি আরবের মধ্যে দ্বন্দ্বের মূল কারণ হল দুই দেশের মধ্যকার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতপার্থক্য। ভারত একটি বহুসংস্কৃতির দেশ, যেখানে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ, জৈন, বৌদ্ধসহ বিভিন্ন ধর্মের লোকজন বসবাস করে। অন্যদিকে, সৌদি আরব একটি ইসলামী দেশ, যেখানে অন্যান্য ধর্মের মানুষ নেই বললেই চলে। ধর্মীয় পার্থক্য ছাড়াও দেশ দুটির মধ্যে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কিছু মতবিরোধ লক্ষ্য করা যায়, যার মধ্যে কাশ্মীর ইস্যু ও ইসরাইল দেশের স্বীকৃতি অন্যতম। সৌদি আরব কখনো সরাসরি ভারতের বিপক্ষে কথা না বললেও কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক দিক থেকে সব সময় পাকিস্তানকে সহায়তা করে এসেছে এবং সৌদি আরব পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশ।
৯. বাংলাদেশ
ভারত ও বাংলাদেশ দুটি প্রতিবেশী দেশ, যাদের মধ্যে দীর্ঘ এবং জটিল ইতিহাস রয়েছে। এই ইতিহাসে উভয় দেশের মধ্যে সহযোগিতা এবং দ্বন্দ্বের মিশ্রণ রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে ভারত বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সহায়তা করে থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে দেশ দুটির মধ্যে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে বিরোধ দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত বিরোধ, তিস্তার পানি বন্টন এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ অন্যতম। এছাড়াও বর্তমান ভারত সরকারের হিন্দুত্ববাদী নীতি ও আগ্রাসনকে বাংলাদেশের মুসলিমরা পছন্দ করে না এবং ভারত সরকারের বিরোধিতা করে। ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক প্রায়ই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
আরো জানুন: ভারতের বন্ধু ১০টি দেশ
৮. শ্রীলংকা
ভারত ও শ্রীলংকা দুটি প্রতিবেশী দেশ, যারা দীর্ঘদিন ধরে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। তবে, দুটি দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিরোধ রয়েছে, যা কখনও কখনও উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। এর সূত্রপাত ঘটে ১৯৮৩ সালে শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে। সে সময় ভারত শ্রীলঙ্কার তামিল বিদ্রোহীদের সমর্থন করেছিল, যা শ্রীলঙ্কার সরকারের সাথে ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। এছাড়াও সমুদ্রসীমা বিরোধ, শ্রীলংকার অভ্যন্তরীণ বিষয় হস্তক্ষেপ ও আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে ভারতের বিপক্ষে। ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে দ্বন্দ্ব এখনও বিদ্যমান এবং উভয় দেশই এই বিরোধগুলি সমাধান করার জন্য কাজ করছে।
৭. অস্ট্রেলিয়া
ভারত ও অস্ট্রেলিয়া উভয়ই বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক শক্তি, এবং তারা তাদের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্বার্থের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। দুটি দেশই কমনওয়েলথের সদস্য ও তারা উভয়ই একটি মুক্ত অর্থনীতি এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। তবে, সম্প্রতি সময়ে উভয় দেশের মধ্যে কিছু বিরোধ দেখা দিয়েছে যার মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা অন্যতম। এছাড়াও অস্ট্রেলিয়ায় ভারতের অভিবাসীদের, অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখছে যারা দেশটির চাকরির বাজার ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে,ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার সম্পর্কে অস্ট্রেলিয়ান সরকারের অবস্থান ভারতের সরকার দ্বারা সমালোচিত হয়েছে। তবে, দুটি দেশই তাদের দ্বন্দ্বগুলি সমাধান করার লক্ষে কাজ করছে।
৬. ইরান
ভারত ও ইরান মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। দেশ দুটির মধ্যে সরাসরি কোন বিরোধ নেই তবে কিছু মতবিরোধ ও কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। এই দ্বন্দ্বের প্রধান কারণগুলির মধ্যে রয়েছে কাশ্মীর ইস্যু,ইরানের পরমাণু কর্মসূচী, হিজবুল্লাহের সাথে সম্পর্ক এবং ধর্মীয় মতবিরোধ। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, ভারত ও ইরান মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়েছে। এছাড়াও ইরানের অন্যতম শত্রু আমেরিকার সাথে ভারতের ভালো সম্পর্ক। এই দ্বন্দ্বগুলি ভারত ও ইরানের মধ্যে সম্পর্কের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। দেশ দুটি কূটনৈতিকভাবে যোগাযোগ করলেও, তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক বা সামরিক সহযোগিতা খুব কম।
আরো জানুন: বিশ্বের চিরশত্রু ১০টি দেশ
৫. পর্তুগাল
ভারত ও পর্তুগাল এর মধ্যে বিরোধের মূল কারণ ছিল ভারতের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে পর্তুগিজদের ঔপনিবেশিক শাসন। ১৫শ শতাব্দীতে ভারতে পৌঁছে পর্তুগিজরা ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট উপনিবেশ স্থাপন করেছিল যার মধ্যে গোয়া, দামান, দিউ, এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ উল্লেখযোগ্য। ভারতের স্বাধীনতার পর, ভারত সরকার এই উপনিবেশগুলিকে ভারতের সাথে একীভূত করার চেষ্টা করে। কিন্তু পর্তুগাল এই উপনিবেশগুলিকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে। ফলে ১৯৬১ সালে ভারতীয় সৈন্যরা গোয়া সহ অন্যান্য উপনিবেশে আক্রমণ করে উপনিবেশগুলিকে দখল করে নেয়। ফলে ভারত ও পর্তুগালের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু ১৯৭৪ সালে পর্তুগালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর, পর্তুগাল ভারতের সাথে আলোচনার মাধ্যমে এই উপনিবেশগুলিকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করে। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও এই হার তারা এখনো ভুলতে পারে নি।
৪. তুরস্ক
ভারত ও তুরস্কের মধ্যে দ্বন্দ্বের ইতিহাস ১১ শতকে শুরু হয়, যখন তুর্কিরা ভারত আক্রমণ করে। তবে বর্তমান সময়ে ভারত ও তুরস্কের মধ্যে বিরোধের মূল কারণ হল কাশ্মীর ইস্যু। তুরস্ক ভারতের কাশ্মীরের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে না এবং ২০১৯ সালে ভারত সরকার কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনকে বাতিল করার পর তুরস্ক ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান কাশ্মীরকে "পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট" বলে অভিহিত করেন। ফলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তুরস্ক সফর বাতিল করা হয় এবং তুরস্কের সাথে ভারতের কয়েক বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের নৌ-অস্ত্র চুক্তি স্থগিত করা হয়। এছাড়াও তুরস্ক পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র যেখানে ভারত পাকিস্তানকে একটি সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র হিসেবে দেখে।
৩. কানাডা
ভারত ও কানাডার মধ্যে দ্বন্দ্বের ইতিহাস বেশ পুরনো যা ১৯ দশকের শুরুতে পাঞ্জাবের শিখদের কানাডায় অভিবাসনের মাধ্যমে শুরু হয়। দেশ দুটির মধ্যে দ্বন্দ্বের মূল কারণ হল দুটি দেশের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গি। কাশ্মির ইস্যু ভারত ও কানাডার মধ্যে সবচেয়ে বড় বিরোধের বিষয়। ভারত কাশ্মীরকে তার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে দাবি করে, অন্যদিকে কানাডা এটিকে একটি "অগ্রহণযোগ্য আগ্রাসন" বলে অভিহিত করেছে। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় যেমন হিন্দুত্ববাদ, এনআরসি, কৃষি আইন বিভিন্ন বিষয়ের উপর কানাডা প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছে যার ফলে দেশ দুটির সম্পর্ক আরো অবনতি ঘটেছে। বর্তমানে ভারত ও কানাডার মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক কিছুটা উত্তেজনার মধ্যে রয়েছে, কারণ উভয় দেশই একে অপরের কৃষি পণ্য ও পরিষেবাগুলিতে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত, ভারত ও কানাডার মধ্যে দ্বন্দ্ব এখনও অব্যাহত রয়েছে।
আরো জানুন: এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ১০টি দেশ
২. চীন
ভারত ও চীন দ্বন্দ্ব একটি দীর্ঘস্থায়ী দ্বন্দ্ব যা ১৯৪৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর থেকে চলছে। এই দ্বন্দ্বের মূল কারণ হল দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত, অর্থনৈতিক এবং সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কেন্দ্র করে যা প্রায় সময় দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থা সৃষ্টি করে। ভারত ও চীন দ্বন্দ্ব বেশ কয়েকটি সামরিক সংঘর্ষের জন্ম দিয়েছে যার মধ্যে ১৯৬২ সালের চীন–ভারত যুদ্ধ অন্যতম। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তবিরোধ নিয়ে ভারত চীনের সাথে বেশ কয়েকটি সাময়িক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে যার মধ্যে ২০১৩ সালের ডোকলাম সংঘর্ষ ও ২০২০ সালের লাদাখ সংঘর্ষ অন্যতম। লাদাখ সংঘর্ষে ভারতের ২০ জন সেনা নিহত হয়, যা এখন পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় সীমান্ত সংঘর্ষ ছিল। এই সংঘর্ষের পর দুই দেশ সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহারের জন্য আলোচনা শুরু করে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি।
১. পাকিস্তান
ভারত ও পাকিস্তান দ্বন্দ্ব একটি দীর্ঘদিনের বিরোধ যা ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনের পর থেকে বিদ্যমান। বিরোধের মূল কারণগুলির মধ্যে রয়েছে কাশ্মীরের সার্বভৌমত্ব, দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ, এবং ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পার্থক্য। এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে কাশ্মীরের ভূখণ্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে। এই দ্বন্দ্বের ফলে দুই দেশের মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রধান ৪টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এগুলো যথাক্রমে ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালে। এই যুদ্ধের কারণে দুই দেশের মধ্যে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং কাশ্মীরের জনসংখ্যার উপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব এখনও চলমান। দেশ দুটির মধ্যে বিরোধগুলো সমাধানের জন্য বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু এখনও কোনও চূড়ান্ত সমাধান পাওয়া যায়নি। উভয় দেশই পারমাণবিক অস্ত্রশক্তির অধিকারী, এবং তাদের মধ্যে এখনও যুদ্ধের সম্ভাবনা রয়েছে।
এছাড়াও যদি আপনি নিয়মিত বিশ্বের ছোট ছোট অদ্ভুত, রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক বিষয় সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত থাকুন।
ফেইসবুক পেইজ:
ইউটিউব চ্যানেল:
ইনস্টাগ্রাম পেজ: The Earth Bangla
ফেইসবুক গ্রুপ:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not Enter any spam comment or Link in the comment Box