শত্রু ১০টি দেশ
চিরশত্রু শব্দটি প্রায়শই দুটি দেশের মধ্যে এমন একটি দীর্ঘস্থায়ী বিরোধকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয় যা যুদ্ধ বা অন্যান্য সহিংসতার দিকে পরিচালিত করে। কিছু ক্ষেত্রে, এই শত্রুতা দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক ইতিহাসের কারণে হয়ে থাকে। এছাড়াও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় মতাদর্শের কারণে হয়ে থাকে। কিন্তু চিরশত্রুতার এই ধারণাটি সর্বদা পরিবর্তনশীল। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়া এবং ইউক্রেন এক সময় ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল, কিন্তু এখন তারা চিরশত্রু। একইভাবে, ইরান এবং ইস্রায়েল একসময় শত্রু ছিল, কিন্তু এখন তারা শান্তি আলোচনায় জড়িত। The Earth Banglar সেরা ১০ সিরিজের আজকের পর্বে আমরা আপনাদের জানাবো বর্তমান বিশ্বে চিরশত্রু ১০টি দেশ সম্পর্কে।
১০. আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান
আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান দ্বন্দ্ব কয়েক দশক ধরে চলছে যা ১৯৮৮ সালে শুরু হয়েছিল। এই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে রয়েছে নাগর্নো-কারাবাখ, একটি অঞ্চল যা আজারবাইজানের অন্তর্গত, কিন্তু যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আর্মেনিয়ানরা বাস করে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, আর্মেনিয়ানরা নাগর্নো-কারাবাখকে স্বাধীন ঘোষণা করে। এর ফলে আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ানদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়, যা ১৯৯৪ সালে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে শেষ হয়। এই যুদ্ধে প্রায় ৩০,০০০ মানুষ মারা যায় এবং প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে, আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান আবারও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে যা ২০২০ সালের নভেম্বরে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে শেষ হয়। এছাড়াও দেশ দুটির মধ্যে জাতিগত, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক মতবিরোধ রয়েছে।
৯. আর্জেন্টিনা এবং যুক্তরাজ্য
আর্জেন্টিনা এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। দ্বন্দ্বের মূল কারণ হল ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের মালিকানা। ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ আর্জেন্টিনার উপকূল থেকে প্রায় ৪৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত কিন্তু ১৮৩৩ সালে যুক্তরাজ্য এই দ্বীপপুঞ্জগুলি দখল করে নেয়। আর্জেন্টিনা এই দখলকে কখনই স্বীকার করেনি এবং ১৯৮২ সালে দ্বীপপুঞ্জগুলি পুনরুদ্ধার করার জন্য একটি সামরিক অভিযান চালায়। যুদ্ধটি দুই মাস স্থায়ী হয়েছিল এবং যুক্তরাজ্যের কাছে পরাজয় বরণ করে। ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের মালিকানা নিয়ে আর্জেন্টিনা এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যে এখনও দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে। এই দ্বন্দ্বের কারণে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে।
আরো জানুন: বিশ্বের পারমাণবিক শক্তিধর ১০টি দেশ
৮. ইরান এবং ইরাক
ইরান-ইরাক যুদ্ধ ২০ শতকের দ্বিতীয় বৃহত্তম যুদ্ধ ছিল যা ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ইরাক-ইরান যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য কারণগুলি হল শাট আল-আরব নদীর নিয়ন্ত্রণ, কুয়েত দখল ও ইরানি বিপ্লব। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব ঘটে এবং সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে ইরাক এই বিপ্লবকে সমর্থন করেনি। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। ১৯৮০ সালে ইরাক ইরানে আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ মারা যায়। অবশেষে ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে এই যুদ্ধ শেষ হয়। কিন্তু এই যুদ্ধের ভয়াবহতা ইরাক এবং ইরাকের জনগণের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল যা তারা আজও ভুলতে পারেনি।
৭. আমেরিকা এবং চীন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন বিশ্বের দুটি বৃহত্তম অর্থনীতি এবং তারা বিশ্বের সর্বাধিক শক্তিশালী সামরিক শক্তি। তারা অনেক বিষয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী, যার মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য, প্রযুক্তি এবং সামরিক নীতি যা অনেক বছর ধরে চলছে। আমেরিকা এবং চীন উভয়ই বিশ্বব্যাপী বাজারে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে এবং তারা উভয়ই এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এছাড়াও তাইওয়ান ও হংকং ইস্যুতে আমেরিকা বরাবরই চীনের বিরোধিতা করে আসছে এবং এই অঞ্চল দুটিকে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে সমর্থন করে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা কখনও কখনও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করে, কিন্তু এটি এখনও কোনো সামরিক সংঘাতের দিকে নিয়ে যায়নি।
৬. গ্রীস এবং তুরস্ক
গ্রীস এবং তুরস্কের সংঘাতের ইতিহাস কয়েক শতাব্দী পুরোনো। গ্রীস এবং তুরস্কের মধ্যে এই বিরোধ মূলত সাইপ্রাস দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ, পূর্ব এজিয়ান সাগরের তেল ও গ্যাস সম্পদ এবং দুই দেশের মধ্যে সামরিক সমর্থনকে কেন্দ্র করে। এই দ্বন্দ্ব কখনও কখনও সামরিক উত্তেজনায় পরিণত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ১৯৭৪ সালের সাইপ্রাস যুদ্ধ। ১৯৭৪ সালে সাইপ্রাস দ্বীপটি তুরস্ক দ্বারা আক্রমণ করা হয়েছিল, যা দ্বীপটিকে দুটি অংশে বিভক্ত করেছে। এছাড়াও এই দুই দেশের মধ্যে সীমানা অস্পষ্ট, তাই তারা প্রায়ই সমুদ্রের সম্পদকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। গ্রীস এবং তুরস্ক উভয়ই ন্যাটোর সদস্য দেশ, তাই তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ন্যাটোর জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। ন্যাটো চায় যে গ্রীস এবং তুরস্ক তাদের দ্বন্দ্ব শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করুক, কিন্তু এটি এখনও পর্যন্ত সফল হয়নি।
আরো জানুন: বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ১০টি দেশ
৫. উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়া
উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়া দ্বন্দ্ব একটি ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব যা ১৯৪৫ সালে কোরিয়ায় জাপানের আত্মসমর্পণের পর থেকে চলছে। ১৯৪৮ সালে, দুটি রাষ্ট্র স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এই দ্বন্দ্বের মূল কারণ হল দুটি দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পার্থক্য। উত্তর কোরিয়া একটি একদলীয় কমিউনিস্ট রাষ্ট্র যাদের অর্থনীতি সমাজতান্ত্রিক অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যাদের অর্থনীতি পুঁজিবাদী। দুটি দেশই তাদের নিজস্ব সরকারকে কোরিয়ার একমাত্র বৈধ সরকার হিসাবে দাবি করে এবং তারা কখনো একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করেনি। এই দ্বন্দ্বের ফলে ১৯৫০-১৯৫৩ সাল পর্যন্ত কোরিয়ান যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। যুদ্ধটি তিন বছর স্থায়ী হয়েছিল এবং প্রায় ৩ মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিল। এই যুদ্ধের পর থেকে দুই দেশ একটি যুদ্ধবিরতির লাইন দ্বারা বিভক্ত রয়েছে।
৪. চীন এবং জাপান
চীন এবং জাপানের মধ্যে দ্বন্দ্ব একটি দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব যা ১৯ শতকের শেষের দিকে শুরু হয়েছিল। এই দ্বন্দ্বের বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে, যার মধ্যে দক্ষিণ চীন সাগরের দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে বিরোধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চীনের গণহত্যা অন্যতম কারণ। চীন এবং জাপান উভয়ই দক্ষিণ চীন সাগরের কিছু দ্বীপের দাবি করে এবং জাপান চীনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করেছে। এছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান প্রায় ৩০ মিলিয়ন চীনা নাগরিককে হত্যা করেছিল। চীনের সাধারণ জনগণ এখনো এই গণহত্যাকে মনে রেখেছে এবং এই গণহত্যাটি চীনা জনগণের মধ্যে এখনও গভীর ক্ষোভের কারণ।
৩. আমেরিকা এবং রাশিয়া
আমেরিকা এবং রাশিয়া বিশ্বের দুটি বৃহত্তম শক্তি, এবং তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব একটি দীর্ঘ এবং জটিল ইতিহাস রয়েছে। তারা বিশ্বের অনেক বিষয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রাখে, যার মধ্যে রয়েছে সামরিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিষয়। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকা গণতন্ত্র এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থক, অন্যদিকে রাশিয়া কমিউনিস্ট শাসন ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির সমর্থক। এছাড়াও আমেরিকা এবং রাশিয়া বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা করে। এই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিগুলি প্রায়শই দ্বন্দ্বে পরিণত হয় যা বিশ্বের জন্য একটি বড় হুমকি। এই দ্বন্দ্ব বিশ্বকে একটি যুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
আরো জানুন: বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ১০টি দেশ
২. ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন
ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন মধ্যপ্রাচ্যের দুটি দেশ। ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব একটি দীর্ঘস্থায়ী দ্বন্দ্ব যা ১৯৪৮ সাল থেকে চলছে। ইসরাইল ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ডের উপর অবস্থিত। তখন ফিলিস্তিনিরা তাদের ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। তাই ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলকে তাদের ভূখণ্ড দখলদার বলে মনে করে এবং ফিলিস্তিনিরা তাদের ভূখণ্ড ফিরে পেতে চায়। ফলে এই দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে শত্রুতা চলে আসছে। গত কয়েক দশকের সহিংসতা, রাজনৈতিক বিরোধ এবং ব্যর্থ শান্তি আলোচনা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে দ্বন্দ্বকে আরো উসকে দিয়েছে। এই দ্বন্দ্বের কারণে ইসরায়েলিরা প্রায়ই ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালায়। যার ফলে অসংখ্য মানুষ মারা গেছে, আহত হয়েছে এবং বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
১. ভারত এবং পাকিস্তান
ভারত এবং পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত দুটি দেশ। ভারত এবং পাকিস্তান উভয়ই ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। তবে স্বাধীনতার পর থেকেই এই দুটি দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলছে। এই দ্বন্দ্বের মূল কারণ হল কাশ্মীরের ভূখণ্ড। ভারত এবং পাকিস্তান উভয়ই কাশ্মীর অঞ্চলটি নিজেদের বলে দাবি করে। এছাড়াও ভারত একটি হিন্দু-প্রধান দেশ এবং পাকিস্তান একটি মুসলিম-প্রধান দেশ। এই ধর্মীয় পার্থক্যও ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে শত্রুতার অন্যতম কারণ। এই দ্বন্দ্বের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলে প্রায়ই অস্থিরতা এবং সহিংসতা দেখা যায়। এমনকি মাঝে মাঝে এই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়।
এছাড়াও যদি আপনি নিয়মিত বিশ্বের ছোট ছোট অদ্ভুত, রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক বিষয় সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত থাকুন।
ফেইসবুক পেইজ:
ইউটিউব চ্যানেল:
ইনস্টাগ্রাম পেজ: The Earth Bangla
ফেইসবুক গ্রুপ:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not Enter any spam comment or Link in the comment Box