বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০টি টানেল
টানেল বা সুরঙ্গ হল মাটি, পাথর বা সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে খননকৃত একটি ভূগর্ভস্থ যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রাচীন সময়ে টানেল তৈরি করা হতো সেচ ও পয়নিষ্কাশনের কাজে ব্যবহার করার জন্য। তবে আধুনিক যুগে টানেল যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বলা হয়, টানেল নির্মাণ করা প্রকৌশলীদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্প। এরপরেও পুরো পৃথিবী জুড়ে অগণিত সংখ্যক টানেল বিদ্যমান যার মধ্যে আমাদের বাংলাদেশে নির্মাণাধীন রয়েছে বঙ্গবন্ধু টানেল বা কর্ণফুলী টানেল। সাধারণত ২ ধরনের টানেল দেখতে পাওয়া যায়, রেলপথ টানেল অর্থাৎ যে টানেলের মধ্য দিয়ে ট্রেন যাতায়াত করে এবং সড়ক টানেল যার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন যানবাহন চলাচল করে। এছাড়া নরওয়েতে বিশ্বের প্রথম শিপ টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে যার মধ্য দিয়ে জাহাজ চলাচল করতে পারবে। তবে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম ১০টি টানেলের সবগুলোই রেলপথ টানেল। The Earth Banglar সেরা ১০ সিরিজের আজকের পর্বে আমরা জানব বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম ১০টি টানেল এবং বঙ্গবন্ধু টানেল সম্পর্কে।
১. Gotthard Base Tunnel
বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম টানেল এবং দীর্ঘতম রেলপথ টানেল হল গথার্ড বেস টানেল যা সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতমালার মধ্য দিয়ে নির্মিত। এর রেললাইনের দৈর্ঘ্য ৫৭.১ কি.মি. এবং সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য ১৫১.৮৪ কি.মি.। এটি দুই নলবিশিষ্ট রেলপথ টানেল যা উত্তর ও দক্ষিন ইউরোপকে সংযুক্ত করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম এই টানেল নির্মাণে সুইস সরকারের খরচ করতে হয়েছিল প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার এবং এটি তৈরি করতে সময় লেগেছে ১৭ বছর। ১৯৯৯ সালের ৪ নভেম্বর এই টানেলের নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং এর উদ্বোধন করা হয় ২০১৬ সালের ১ জুন। তবে টানেলটি জনসাধারনের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা হয় ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর। কার্যদিবসে গড়ে ১৩০ থেকে ১৬০টি ট্রেন এই টানেলের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করে যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ট্রেনই হল বিভিন্ন মালবাহী ট্রেন। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম গথার্ড বেস টানেলকে একসময় বিশ্বের দীর্ঘতম ট্রানজিট টানেলও বলা হতো।
২. Seikan Tunnel
সেইকন টানেল বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম টানেল যা জাপানের সুগারু জলপ্রণালীর নিচে অবস্থিত এবং দৈর্ঘ্য ৫৩.৯ কি.মি.। ২০১৬ সালের আগ পর্যন্ত এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম টানেল। গথার্ড বেস টানেলের মত সেইকন টানেলও দুই নলবিশিষ্ট রেলপথ টানেল। তবে এর বিশেষত্ব হচ্ছে রেলপথটির প্রায় ২৩.৩ কি.মি. পানির ১০০ মিটার নিচে অবস্থিত যার কারনে সেইকন টানেল বিশ্বের দীর্ঘতম তলদেশের টানেল হিসেবে পরিচিত। জাপানের দীর্ঘতম এই টানেলটি জাপানের হোনশু ও হোক্কাইদো দ্বীপের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়েছে। ১৯৭১ সালে এই টানেলের নির্মাণকাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৮৮ সালে। বিশাল এই টানেল নির্মাণে খরচ হয়েছিল প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার। প্রতিদিন প্রায় ৫০টি মালবাহী ট্রেন এবং ৩০টি বুলেট ট্রেন এই টানেল দিয়ে যাতায়াত করে।
আরো জানুন: বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম ১০টি মেট্রোরেল
৩. Channel Tunnel
চ্যানেল টানেল হল একটি দুই নলবিশিষ্ট পাতাল রেলপথ টানেল যা ফ্রান্স ও গ্রেট ব্রিটেনকে যুক্ত করেছে। ৫০.৫ কি.মি. দীর্ঘ এই টানেলটি ইংলিশ চ্যানেলের উপসাগরের মধ্যে দিয়ে নির্মিত হয়েছে। বর্তমানে এটি বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম টানেল যার সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড় গভীরতা ৪৫ মিটার। সর্বপ্রথম ১৮০২ খ্রিষ্টাব্দে, ইংলিশ চ্যানেলের তল দিয়ে ফ্রান্স ও গ্রেট ব্রিটেনের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের এই প্রকল্পটি উত্থাপিত হয়েছিল কিন্তু প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে এক শতাব্দীরও বেশি সময় লেগে যায়। এই টানেলের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৮৮ সালে এবং জনসাধারনের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা হয় ১৯৯৪ সালে। প্রতিদিন গড়ে ৬০ হাজার যাত্রী এই টানেলের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করে।
৪. Yulhyeon Tunnel
ইউলহিউন টানেল হল বিশ্বের চতুর্থ দীর্ঘতম এবং দক্ষিণ কোরিয়ার বৃহত্তম টানেল যার দৈর্ঘ্য ৫০.৩ কি.মি.। এটি দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল ও পিয়ংতেক শহরকে সংযুক্তকারী একটি এক নলবিশিষ্ট রেলপথ টানেল। টানেলটি নির্মাণ করতে ৩ বছর ৫ মাস সময় লেগেছিল এবং ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে এটি ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এই টানেলে প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩০০ কি.মি. গতির ট্রেন চলাচল করতে সক্ষম।
৫. Songshan Lake Tunnel
অবকাঠামোগতভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কথা বললে প্রথম সারিতেই চলে আসে চীনের কথা। আর তাই বিশ্বের দীর্ঘতম ১০টি টানেল মধ্যে ৪টিই চীনে অবস্থিত। চীনের তুংকুয়ান প্রদেশে অবস্থিত সংশান লেক টানেল বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘতম এবং চীনের বৃহত্তম টানেল যার দৈর্ঘ্য ৩৫.৪ কি.মি.। এটি একটি রেলপথ টানেল এবং এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছিল ২০১৬ সালে।
আরো জানুন: বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম ১০টি নদী
৬. Lötschberg Base Tunnel
Lötschberg বেস টানেল বিশ্বের ষষ্ঠ দীর্ঘতম টানেল যা সুইজারল্যান্ডের বার্নিজ আল্পস পর্বতমালার মধ্য দিয়ে নির্মিত। ৩৪.৬ কি.মি. দৈর্ঘ্যের এই রেলপথ টানেলটি সুইজারল্যান্ডের ফ্রুটিজেন ও রারন কে সংযুক্ত করেছে। ১৯৯৯ সালে এই টানেলটির নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় ২০০৭ সালে। গথার্ড বেস টানেল নির্মাণের পূর্বে এটি ছিল বিশ্বের দীর্ঘতম স্থল রেলপথ।
৭. New Guanjiao Tunnel
নিউ গুয়াঞ্জিয়াও টানেল হল চীনের গুয়াঞ্জিয়াও পর্বতে ছিংহাই-তিব্বত রেলওয়ের ২য় লাইনের একটি টানেল। ডবল-ট্র্যাক রেলপথের এই টানেলটি বিশ্বের সপ্তম দীর্ঘতম এবং চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম টানেল যার দৈর্ঘ্য ৩২.৬৫ কি.মি.। ২০০৭ সালে এই টানেলের নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে এটিকে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এই টানেলকে বিশ্বের সর্বোচ্চ উচ্চতার টানেল বলা হয় কেননা এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৩০০ মিটারেরও বেশি উচ্চতায় নির্মিত।
৮. Guadarrama Tunnel
গুয়াদারামা টানেল স্পেনের দীর্ঘতম এবং বিশ্বের অষ্টম দীর্ঘতম টানেল। সিয়েরা দে গুয়াদাররামা পর্বতমালার মধ্য দিয়ে ২৮.৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই টানেলটি খনন করা হয়েছে। এটি একটি দুই নলবিশিষ্ট রেলপথ টানেল যা মাদ্রিদ-লিওন হাইস্পিড রেললাইনের একটি অংশ হিসেবে নির্মিত হয়েছে। ২০০২ সালে এটির নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় ২০০৭ সালে।
আরো জানুন: বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম ১০টি সেতু
৯. West Qinling Tunnel
বিশ্বের নবম দীর্ঘতম টানেল হল ওয়েস্ট ছিনলিং টানেল যা চীনের গানসু প্রদেশের উদু জেলায় অবস্থিত এবং এর দৈর্ঘ্য ২৮.২ কিলোমিটার। এই টানেলটি লানচৌ-ছুংছিং রেলওয়ের একটি কেন্দ্রীয় অংশ যা ছিনলিং পর্বতমালা অতিক্রম করে। চীনের তৃতীয় বৃহত্তম এই টানেল তৈরির কাজ শুরু হয় ২০০৮ সালে এবং শেষ হয় ২০১৬ সালে।
১০. Taihang Tunnel
সংশান লেক, নিউ গুয়াঞ্জিয়াও এবং ওয়েস্ট ছিনলিং টানেলের পর চীনের চতুর্থ দীর্ঘতম এবং বিশ্বের দশম দীর্ঘতম টানেল হল তাইহাং টানেল যার দৈর্ঘ্য ২৭.৮ কিলোমিটার। এটি একটি ডাবল ট্র্যাক রেলওয়ে টানেল যার নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১১ জুন ২০০৫ সালে এবং শেষ হয় ২২ ডিসেম্বর ২০০৭ সালে। এটি শিজিয়াজুয়াং-তাইয়ুয়ান হাইস্পিড রেলপথের একটি অংশ যা তাইহাং পর্বত মধ্য দিয়ে যাতায়াত করে। এই টানেলের নির্মাণের পর চীনের শিজিয়াজুয়াং থেকে তাইয়ুয়ান শহর পর্যন্ত ভ্রমণের সময় ছয় ঘণ্টা থেকে কমে মাত্র এক ঘণ্টায় নেমে আসে।
বঙ্গবন্ধু টানেল বা কর্ণফুলী টানেল
বিশ্বের অন্য অনেক দেশের মত টানেলের যুগে প্রবেশ করতে চলেছে আমাদের বাংলাদেশ। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর নিচে নির্মাণাধীন এই টানেলের নাম রাখা হয়েছে বঙ্গবন্ধু টানেল বা কর্ণফুলী টানেল। এই টানেলটির মূল দৈর্ঘ্য ৩.৩২ কিলোমিটার। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং আশা করা হচ্ছে ২০২৩ এ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে। উদ্বোধনের পর এটিই হতে চলেছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নদীর তলদেশে সড়ক টানেল।
এছাড়াও যদি আপনি নিয়মিত বিশ্বের ছোট ছোট অদ্ভুত, রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক বিষয় সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত থাকুন।
ফেইসবুক পেইজ:
ইউটিউব চ্যানেল:
ইনস্টাগ্রাম পেজ: The Earth Bangla
ফেইসবুক গ্রুপ:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not Enter any spam comment or Link in the comment Box