পৃথিবীর ডুবন্ত ১০টি শহর
বর্তমানে পৃথিবীতে এমন অনেক শহর রয়েছে যে শহরগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র কয়েক মিটার উপরে অবস্থিত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে সমুদ্র উপকূলীয় অনেক শহর পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এর আগেও মানব ইতিহাসে অনেক শহর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ভূমিকম্প, সুনামি বা বন্যার কারণে পানিতে তলিয়ে গেছে। গবেষকদের ধারণা মতে জলবায়ুর এই পরিবর্তন অব্যাহত থাকলে ২১০০ সালের মধ্যে, বিশ্বের অনেক বড় বড় শহর পানির নিচে চলে যাবে এবং বিশ্বের প্রায় ১০০ কোটি মানুষ তাদের বাড়িঘর হারাতে পারে। The Earth Banglar সেরা ১০ সিরিজের আজকের পর্বে আমরা আপনাদের জানাবো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ২১০০ সালের মধ্যে পানির নিচে ডুবে যাবে এমন ১০টি শহর সম্পর্কে।
১০. হো চি মিন সিটি, ভিয়েতনাম
হো চি মিন সিটি ভিয়েতনামের সববৃহৎ শহর যা আগে সাইগন নামে পরিচিত ছিল। এটি একটি সমুদ্র উপকূলীয় শহর যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০১৮ সালে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের যে ১০টি শহর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে তার মধ্যে হো চি মিন সিটি অন্যতম।যদি জলবায়ুর এই পরিবর্তন অব্যাহত থাকে এবং কোনও ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, ২০৫০ সালের মধ্যে, হো চি মিন সিটির প্রায় ৪০% এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১ মিটার পানির নিচে তলিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৮০ সালের মধ্যে, সম্পূর্ণ শহরটি পানির নিচে চলে যেতে পারে।
৯. লাগোস, নাইজেরিয়া
লাগোস হল নাইজেরিয়ার সবচেয়ে জনবহুল এবং বৃহত্তম শহর। এটি একটি দ্বীপ শহর যা ক্রমবর্ধমান সমুদ্রের স্তরের বৃদ্ধির কারণে ঝুঁকির মুখে রয়েছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের পানি বৃদ্ধির কারণে বার বার প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে নাইজেরিয়ার উপকূলবর্তী এই শহরটি। এক গবেষণায় দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই উপকূলের পানির উচ্চতা ৩ থেকে ৯ ফুট পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। ২০১৮ সালে, নাইজেরিয়ার জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতীয় কাউন্সিল পূর্বাভাস করেছিল যে, ২০৫০ সালের মধ্যে লাগোসের ৬০% এবং ২১০০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ লাগোস সমুদ্রের নিচে চলে যাবে।
আরো জানুন: বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ১০টি শহর
৮. মুম্বাই, ভারত
মুম্বাই হল ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর। এটি একটি উপকূলবর্তী শহর এবং শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। এছাড়াও মুম্বাইয়ের ৮০% এরও বেশি ভবন সমুদ্রপৃষ্ঠের নীচে অবস্থিত এবং প্রতি বছর প্রায় ১ ইঞ্চি করে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৯ সালে, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ২০৫০ সালের মধ্য মুম্বাইয়ের অধিকাংশ অঞ্চল সমুদ্রে তলিয়ে যেতে পারে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২১০০ সালের মধ্যে মুম্বাই সম্পূর্ণরূপে পানির নিচে চলে যাবে। তবে মুম্বাইয়ের পানিতে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে ভিন্ন মতামতও রয়েছে।
৭. নিউ অরলিন্স, লুইসিয়ানা
নিউ অরলিন্স হল যুক্তরাষ্ট্রের লুইসিয়ানা রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে অবস্থিত একটি শহর। এটি মিসিসিপি নদীর তীরে অবস্থিত এবং সমুদ্রপৃষ্ঠে উচ্চতার কারণে শহরটি বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। শহরটিকে রক্ষা করার জন্য একটি বিশাল বাঁধ রয়েছে, তবে শহর রক্ষার জন্য এটি যথেষ্ট নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং প্রতি বছর ২ ইঞ্চি হারে ডুবে যাচ্ছে নিউ অরলিন্স শহরটি। যদি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এই একই হরে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে, তাহলে নিউ অরলিন্স ২১০০ সালের মধ্যে পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে। নাসার ২০১৬ সালের একটি গবেষণা থেকে জানা গেছে, ইতিমধ্যেই শহরের কিছু অংশ সুমদ্রপৃষ্ঠের ১৫ ফুট নিচে রয়েছে।
৬. আমস্টারডাম, নেদারল্যান্ড
আমস্টারডাম হল নেদারল্যান্ডসের রাজধানী এবং এটি বিশ্বের সবচেয়ে নিচু রাজধানীগুলির মধ্যে একটি যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৬.৭ মিটার উপরে অবস্থিত। আমস্টারডামকে "পানির শহর" বলা হয় কারণ এই শহরের প্রায় ৬০% এলাকা পানির নিচে অবস্থিত, এবং এর অনেক রাস্তা ও বাড়ি খালের উপর নির্মিত। শহরটি একটি জলাভূমিতে নির্মিত এবং এটি প্রাকৃতিকভাবেই বন্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আমস্টারডামের বাসিন্দারা শতাব্দীকাল ধরে দীর্ঘ খাল খনন এবং সেতু নির্মাণ করে শহরটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই খালগুলি শহরের জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। তবে কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে সম্পূর্ণ শহরটি ২১০০ সালের মধ্যে পানিতে তলিয়ে যেতে পারে।
আরো জানুন: বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ১০টি শহর
৫. কলকাতা, ভারত
কলকাতা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী এবং একটি সমুদ্র উপকূলীয় শহর যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। উপকূলীয় শহর হওয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কলকাতা ঝুঁকির মুখে রয়েছে। তাই কলকাতা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে অনেকগুলি গবেষণা করা হয়েছে। ২০১৮ সালে, জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের ১০টি শহর পানিতে তলিয়ে যেতে পারে যার মধ্যে কলকাতাও রয়েছে।
৪. ভেনিস, ইতালি
ভেনিস ইতালির একটি শহর যা ভূমধ্যসাগরের উত্তর-পূর্বে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের উপকূলে অবস্থিত। এটি ভেনেটিয়ান উপহ্রদের ৪০০টি দ্বীপের উপর নির্মিত এবং দ্বীপগুলিকে ৪০০টি সেতু দিয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। তাই ভেনিস শহরের প্রধান পরিবহন ব্যবস্থা হল নৌকা। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠের নীচে অবস্থিত একটি শহর এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে শহরটি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। শহরটি প্রতি বছর ০.৮ ইঞ্চি হারে নিমজ্জিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান হার যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে ভেনিস সম্পূর্ণরূপে পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। তাই শহরটিকে বাঁচাতে দেশটির সরকার ৬.৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করে বাঁধ নির্মাণ করেছে।
৩. ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ব্যাংকক হল থাইল্যান্ডের রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর যা চিয়াও ফ্রায়া নদীর তীরে অবস্থিত। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে, ব্যাংকক পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গার্ডিয়ানে'র মতে, ব্যাংকক শহরটি বছরে ১ ইঞ্চির বেশি হারে ডুবে যাচ্ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে ব্যাংকক সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বন্যার ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। আশংকা করা হচ্ছে ক্রমবর্ধমান সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, তীব্র বৃষ্টিপাত এবং ভূমি ক্ষয়ের কারণে ব্যাংকক ২১০০ সালে পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। তবে, ব্যাংকক সরকার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি মোকাবেলা করার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে।
২. মিয়ামি, ফ্লোরিডা
মিয়ামি শহরটি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের উপকূলবর্তী একটি শহর যা সমুদ্রপৃষ্ঠের মাত্র কয়েক ফুট উপরে অবস্থিত। বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে মিয়ামি শহর পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর প্রায় ১ মিলিমিটার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে, ২০৫০ সালের মধ্যে মিয়ামি শহরের প্রায় ২০% এবং ২০৭০ সালের মধ্যে শহরের প্রায় ৬০% এলাকা পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। এমনকি ২০৯০ সালের মধ্যে পুরো শহরটাই তলিয়ে যেতে পারে। এই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বর্তমানে শহরটিতে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানছে।
আরো জানুন: বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ১০টি শহর
১. জাকার্তা, ইন্দোনেশিয়া
জাকার্তা ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর। এটি জাভা দ্বীপের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত এবং বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধমান শহরগুলির মধ্যে একটি। শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠের সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬ মিটার নীচে অবস্থিত এবং প্রতি বছর ৬.৭ ইঞ্চি পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছে শহরটি। ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং শহরটি সম্পূর্ণ ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। গবেষকদের মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে জাকার্তার ৬০% এবং ২০৭০ সালের মধ্যে শহরটি সম্পূর্ণরূপে তলিয়ে যেতে পারে। তাই দেশটির সরকার নতুন শহর করার জন্য ইতিমধ্যেই ৩৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
ঢাকা, বাংলাদেশ
এবার আসি আমাদের ঢাকা শহরের কথায়। উপরের তালিকায় ঢাকার নাম না থাকলেও ঢাকার তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও কম নয়। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর। এটি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত একটি সমতল শহর, যার গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৮ মিটার। ধারণা করা হচ্ছে পানির উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ১ কোটি ১৮ লাখ লোক তাদের আবাসস্থল হারাবে এবং দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ১৭ শতাংশ জমি পানি নিচে তলিয়ে যাবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্য অনুসারে, ২১০০ সালের মধ্যে ঢাকা পুরোপুরি অথবা আংশিক ডুবে যেতে পারে।
এছাড়াও যদি আপনি নিয়মিত বিশ্বের ছোট ছোট অদ্ভুত, রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক বিষয় সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত থাকুন।
ফেইসবুক পেইজ:
ইউটিউব চ্যানেল:
ইনস্টাগ্রাম পেজ: The Earth Bangla
ফেইসবুক গ্রুপ:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not Enter any spam comment or Link in the comment Box