বিশ্ব মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়া ১০টি দেশ

প্রাচীন সাম্রাজ্যের পতন থেকে শুরু করে নতুন দেশের আত্মপ্রকাশ কিংবা স্থানের নাম পরিবর্তনের ফলে বিশ্ব মানচিত্র প্রতিনিয়তই বদল হচ্ছে। এই সময়ের ব্যাবধানে অনেক দেশ যেমন গঠিত হয়েছে, তেমনি অনেক দেশ আবার মানচিত্র থেকে হারিয়েও গিয়েছে। পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে যেগুলো একসময় ছিল কিন্তু এখন আর নেই। কিছু দেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে হারিয়ে গেছে আবার কিছু দেশ যুদ্ধ বা সংঘাতের কারণে হারিয়ে গেছে বা দখল করা হয়েছে। The Earth Banglar সেরা ১০ সিরিজের আজকের পর্বে আমরা আপনাদের জানাবো বিশ্ব মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়া ১০টি দেশ সম্পর্কে।

১০. সিকিম

সিকিম ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত একটি রাজ্য হিসেবে সিকিম পরিচিত হলেও পূর্বে এটি একটি স্বাধীন রাজতন্ত্র ছিলো। সিকিমের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। ধারণা করা হয় যে সিকিমে প্রায় ৫০০০ বছর আগে থেকেই মানুষের বসবাস ছিল। প্রাচীনকালে সিকিম ছিল বিভিন্ন উপজাতির আবাসস্থল। ১৬৪২ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত সিকিম একটি সার্বভৌম দেশ ছিল। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে এটি ভারতের একটি প্রদেশে রুপ নেয়। সিকিমের রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর হল গ্যাংটক। সিকিম তার সুন্দর পাহাড়ি দৃশ্য, ঝর্ণা, হ্রদ এবং দূষণমুক্ত পরিবেশের জন্য বিখ্যাত। ভূটান, তিব্বত ও নেপালের সীমান্তে থাকা সিকিমকে স্থানীয়রা ঈশ্বরের বাড়ি বলে সম্বোধন করে।

৯. সিকিম

তিব্বত চীনের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল যা চীনের পশ্চিমে অবস্থিত। এটি প্রাচীনকাল থেকেই একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। মূলত ১৯১২ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিব্বত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছিলো। তবে ১৯৫০ সালের শেষের দিকে চাইনিজ লিবারেশন আর্মি তিব্বতকে আক্রমণ করে এবং দখল করে নেয়। তিব্বতীরা চীনের এই দখলকে কখনো স্বীকার করেনি এবং এবং তাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চীনের বিরুদ্ধে তিব্বতের স্বাধীনতার জন্য সমর্থন চেয়েছে। আধ্যাত্মিক ও শান্তিপূর্ণ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ছাড়াও তিব্বত নোবেল জয়ী নেতা দালাই লামার জন্য বিখ্যাত।

আরো জানুন: বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ১০টি শহর

৮. নিউট্রাল মরেসনেট

নিউট্রাল মরেসনেট নামে দেশের কথা বেশিরভাগ মানুষই শোনেনি। প্রায় এক বর্গ মাইলের ছোট্ট এই দেশটির অস্তিত্ব ছিলো ১৮১৬ সালের দিকে। মূলত ডাচ ও প্রুসিয়ানরা জিংকের খনি ব্যবহারের জন্য এই ভূখণ্ডটিকে একটি আলাদা দেশে পরিণত করে, যাতে করে উভয় দেশেরই এই নতুন ভূখন্ডটিতে প্রবেশাধিকার থাকে। ছোট্ট এই দেশটির নিজস্ব পতাকা, মুদ্রা ছাড়াও এস্পেরান্তো নামে একটি আলাদা ভাষাও ছিলো। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শিকার হয়ে পরে এই দেশটি বেলজিয়ামের একটি অংশে পরিণত হয়। তারপরও বর্তমান স্থানীয়রা প্রতিবছর নিউট্রাল মরেসনেটের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উৎসবের সাথে পালন করে।

৭. যুগোস্লাভিয়া

যুগোস্লাভিয়া ছিল ইউরোপের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি রাষ্ট্র যা ১৯১৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। ১৯১৮ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য এবং অটোমান সাম্রাজ্যের পতন হলে যুগোস্লাভিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশটিকে প্রথমে "সার্ব ক্রোয়েশিয়ান এবং স্লোভেনদের রাজত্ব" বলা হত, কিন্তু ১৯২৯ সালে নামটি পরিবর্তন করে যুগোস্লাভিয়া করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত  কমিউনিস্ট নেতাদের প্রচেষ্টায় সব জাতি এক থাকলেও ১৯৯০ এর শেষের দিকে পুরোপুরি ভেঙে যায় যুগোস্লাভিয়া। একে একে জন্ম নেয় স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, বসনিয়া হার্জেগোভিনা, মন্টেনেগ্রো, কসোভো এবং মেসেডোনিয়া। যুগোস্লাভিয়ার পতনের মূল কারণ ছিল জাতিগত ও ধর্মীয় সংঘাত। 

৬. চেকোস্লোভাকিয়া

চেকোস্লোভাকিয়া ছিল মধ্য ইউরোপের একটি দেশ যা ১৯১৮ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। পূর্ব ইউরোপে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৯১৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ার আত্মপ্রকাশ করে। ঐতিহাসিক এলাকা মোরাভিয়া, স্লোভাকিয়া এবং বোহেমিয়া অঞ্চল নিয়ে তৈরি হয় দেশটি। এটি একটি বহুজাতিক দেশ ছিল, যেখানে চেক, স্লোভাক, জার্মান, হাঙ্গেরিয়ান এবং অন্যান্য জাতির লোকেরা বাস করত। এছাড়াও চেকোস্লোভাকিয়া একটি উন্নত এবং শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ ছিল। ১৯৯৩ সালে চেকোস্লোভাকিয়া ভেঙে যায় এবং জন্ম নেয় চেক রিপাবলিক ও স্লোভাকিয়া নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র।

আরো জানুন: বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ১০টি মসজিদ

৫. প্রুশিয়া

প্রুশিয়া ছিল একটি মধ্য ইউরোপীয় দেশ যা ১৬২৫ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এটি মূলত বর্তমান জার্মানি, পোল্যান্ড এবং লিথুয়ানিয়ার অধিকাংশ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। ১৮ শতকে প্রুশিয়া ইউরোপের অনেক রাজ্য দখল করলেও ১৯ শতকের শুরুর দিকে সেগুলো হারাতে শুরু করে। ১৮৭১ সালে ফ্রাংকো-প্রুসিয়ান যুদ্ধ জেতার পর এই সাম্রাজ্যটি জার্মানি নামে আত্মপ্রকাশ শুরু করে। কারণ প্রুশিয়ানরা ছিল মূলত প্রাচীন জার্মানদের বংশধর। যদিও সেই সময় জার্মানি প্রুশিয়ার একটি প্রদেশ হিসেবে টিকে ছিলো। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি পোল্যান্ডকে মুক্ত করতে বাধ্য হয়, যা প্রুশিয়া প্রদেশের কিছু অংশ ছিলো। ফলে বিশ্ব মানচিত্র থেকে প্রুশিয়া দেশটি পুরোপুরি মুছে যায়। প্রুশিয়া বিলুপ্ত হয়ে গেলেও প্রুশিয়ান সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আজও জার্মানি এবং অন্যান্য দেশে টিকে আছে।

৪. পারস্য

পারস্যের হল বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতা গুলির মধ্যে একটি যা ৫৫০ থেকে ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ সালে রাজা দ্বিতীয় সাইরাস গড়ে তোলেন পারস্য সাম্রাজ্য। এটি পারস্যের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ থেকে শুরু হয়ে উত্তর-পশ্চিমে ইউরোপের বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য এবং দক্ষিণে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পারস্য সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের আক্রমণের ফলে। এই দেশটি ১৯৩৫ সালের আগপর্যন্ত পারস্য নামেই পরিচিত ছিলো, বর্তমানে যা ইরান নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। তবে পারস্যের সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য ইরানে এখনো জীবন্ত। এটি বিশ্বের প্রথম সাম্রাজ্যগুলির মধ্যে একটি ছিল যা বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেছিল।

৩. আবিসিনিয়া

আবিসিনিয়া হল ইথিওপিয়া দেশের প্রাচীন নাম। এটি একটি প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্র ছিল। আবিসিনিয়া কখনো বিদেশী পরাশক্তির দ্বারা শাসিত হয়নি অর্থাৎ দেশটি কখনও বিদেশী শক্তির অধীন ছিল না এবং আফ্রিকার গুটিকয়েক স্বাধীন দেশগুলোর মধ্যে একটি ছিলো। উনিশ শতকের দিকে আবিসিনিয়া, ইতালি দ্বারা আক্রমণ শিকার হয় কিন্তু ইতালি আবিসিনিয়ার সাম্রাজ্যের পতন ঘটাতে ব্যর্থ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ আবিসিনিয়াকে ইথিওপিয়াতে রুপ দিয়ে স্বাধীন ভূখন্ড হিসেবে ঘোষণা করা হয়। উল্লেখ্য, সবচেয়ে প্রাচীন মানুষের ফসিল পাওয়া যায় এই ইথিওপিয়াতেই।

আরো জানুন: বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ১০টি ভাষা

২. নিউফাউন্ডল্যান্ড

নিউফাউন্ডল্যান্ড উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলে অবস্থিত বৃহত্তম দ্বীপ যা ১৯০৭ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলো। আঠারো শতকের শুরুর দিকে এই দ্বীপটি ব্রিটিশ কলোনির অন্তর্গত ছিলো। সেই সময় দ্বীপটির মূল অর্থনৈতিক খাত ছিলো মাছ আহরণ। কিন্তু ১৯৩০ সালের পর থেকে অর্থনৈতিক খাতে বিপর্যয় আসলে দেশটির লোকজন স্বেচ্ছায় ব্রিটিশদের কলোনাইজেশনে ফিরে যেতে চায়। তবে ১৯৪৯ সালে জনগণের ভোটাভুটির মাধ্যমে দ্বীপটি স্থায়ীভাবে কানাডার সাথে যুক্ত হয়। বর্তমানে নিউফাউন্ডল্যান্ড কানাডার দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রদেশ এবং এটিকে অনেকে ল্যাব্রাডর নামেও চিনে থাকে।

১. সোভিয়েত ইউনিয়ন

সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল এশিয়ার থেকে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত একটি বৃহত্তর সমাজতান্ত্রিক দেশ যার অস্তিত্ব ছিল ১৯১৮ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। এটি বিশ্বের বৃহত্তম এবং দ্বিতীয় জনবহুল রাষ্ট্র ছিল। এছাড়াও সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল একটি শক্তিশালী সামরিক শক্তির দেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালে, সোভিয়েত ইউনিয়নে একটি গণঅভ্যুত্থান হয়। এই গণঅভ্যুত্থানে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ঘটে ও ১৫টি নতুন রাষ্ট্র গঠিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে বিশ্বের মানচিত্রের একটি বড় পরিবর্তন ঘটে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি হয়ে ওঠে।

এছাড়াও যদি আপনি নিয়মিত বিশ্বের ছোট ছোট অদ্ভুত, রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক বিষয় সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত থাকুন।

ফেইসবুক পেইজ: The Earth Bangla

ইউটিউব চ্যানেল: The Earth Bangla

ইনস্টাগ্রাম পেজ: The Earth Bangla

ফেইসবুক গ্রুপ: The Earth Bangla Family

Post a Comment

Please do not Enter any spam comment or Link in the comment Box

নবীনতর পূর্বতন