বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্রতম ১০টি দেশ
বিশ্বব্যাপী, দারিদ্র্য একটি গুরুতর সমস্যা। একটি দেশকে গরিব বলা হয় যখন তার জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে এবং এমন একটি অবস্থা যেখানে কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণে অক্ষম। এখন লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলির বেশিরভাগই আফ্রিকা মহাদেশে অবস্থিত যে কারণে এই মহাদেশকে পৃথিবীর অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ বলা হয়। মূলত রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, অতিরিক্ত কৃষি নির্ভরতা সহ বিভিন্ন কারণে এই দেশগুলি দারিদ্রে নিমজ্জিত। The Earth Banglar সেরা ১০ সিরিজের আজকের পর্বে আমরা আপনাদের জানাবো মাথাপিছু জিডিপির ভিত্তিতে বিশ্বের সবচেয়ে গরিব ১০টি দেশ সম্পর্কে।
১০. ইরিত্রিয়া
ইরিত্রিয়া আফ্রিকার পূর্ব-উত্তর-পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত একটি বহু-জাতিগত দেশ। এর রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর আসমারা। দেশটির উত্তর-পূর্ব এবং পূর্ব অংশে লোহিত সাগর এর একটি বিস্তৃত উপকূলরেখা রয়েছে। এই দেশটির অর্থনীতির ভিত্তি হলো কৃষি যা জিডিপির প্রায় ২৫% অবদান রাখে এবং জনসংখ্যার প্রায় ৮০% এরও বেশি মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল। প্রধান কৃষিজ পণ্যগুলির মধ্যে রয়েছে ভুট্টা, গম, ডাল, এবং তুলা। এছাড়া লবণ, চুনাপাথর, এবং তেল এর মতো খনিজ সম্পদও কিন্তু রয়েছে দেশটিতে। তবে, সম্প্রতি দেশটিতে শিল্প এবং পর্যটন খাতের উন্নয়ন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যথাযথ সরকারি পরিকল্পনার অভাব, শিক্ষার অভাব ও নানাবিধ কারণে দেশটির প্রায় ৪০% মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে। বর্তমানে দেশটির মাথাপিছু জিডিপি মাত্র ৭০০ মার্কিন ডলার।
৯. মোজাম্বিক
মোজাম্বিক একটি দেশ দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকায় অবস্থিত, যা ভারত মহাসাগরের পূর্ব দিকে অবস্থিত। এর রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর হল মাপুতো। এটি একটি প্রাকৃতিকভাবে সুন্দর দেশ, যার বিস্তৃত উপকূলরেখা, বনভূমি এবং বনভূমি রয়েছে। মোজাম্বিকের অর্থনীতি মূলত কৃষি, মাছ ধরা এবং পর্যটন নির্ভর। প্রচুর পরিমাণে খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ এই দেশে প্রায় ৬০% এর বেশি মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে। দেশটিতে বিপুল পরিমাণে তেল, গ্যাস, সোনা, লোহা, এবং টিন রয়েছে। এই খনিজ সম্পদ খাত জিডিপির ১০% অবদান রাখে। তবে, বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে মোজাম্বিকে যার ফলাফল হয়তো ২০২৬ ও ২০২৮ সাল থেকেই দেশটি পেতে শুরু করবে। বর্তমানে দেশটির মাথাপিছু জিডিপি ৫৭৯ মার্কিন ডলার।
আরো জানুন: এশিয়ার সবচেয়ে উন্নত ১০টি দেশ
৮. নাইজার
নাইজার পশ্চিম আফ্রিকার স্থলবেষ্টিত একটি দেশ যার নাম রাখা হয়েছে নাইজার নদীর নামানুসারে। দেশটির শতকরা ৮০ ভাগ এলাকাজুড়ে রয়েছে সাহারা মরুভূমি। দেশটির প্রায় ৪৪% জনসংখ্যা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে এবং জনসংখ্যার ৪০ শতাংশেরও বেশি প্রতিদিন $১ এর কম আয় করে। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ নাইজারে প্রচুর পরিমাণে তেল, গ্যাস, ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ রয়েছে। তবে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে এই সম্পদগুলির উত্তোলন এবং ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। নাইজারের অর্থনীতি প্রধানত কৃষিনির্ভর যা জিডিপিতে ৪০% অবদান রাখে। প্রধান কৃষিজ পণ্যগুলির মধ্যে রয়েছে ভুট্টা, ময়দা, এবং কাঠ। অপরদিকে তেল ও গ্যাস খাত জিডিপির ১০% অবদান রাখে। বর্তমানে নাইজারের মাথাপিছু জিডিপি মাত্র ৫৭৪ মার্কিন ডলার।
৭. দক্ষিণ সুদান
দক্ষিণ সুদান পূর্ব-মধ্য আফ্রিকায় অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র দেশ যা ২০১১ সালে স্বাধীনতা লাভ করেছিল। দেশটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশটিতে সহিংসতা, দুর্ভিক্ষ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার দ্বারা জর্জরিত। দক্ষিণ সুদানের অর্থনীতির ভিত্তি হল কৃষি এবং কৃষি খাত জিডিপির ৬০% অবদান রাখে। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৮০% এরও বেশি মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল। প্রধান কৃষিজ পণ্যগুলির মধ্যে রয়েছে ভুট্টা, গম, ডাল, এবং তুলা। তবে অতিরিক্ত কৃষিনির্ভরতার জন্যই দেশটির প্রায় ৬০% মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে। অফুরন্ত খনিজ সম্পদ থাকার পরেও দেশটি বিভিন্ন দাতা সংস্থার সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে দেশটির মাথাপিছু জিডিপি ৫৭০ মার্কিন ডলার।
৬. সোমালিয়া
সোমালিয়া উত্তর-পূর্ব আফ্রিকায় অবস্থিত একটি দেশ যার অধিকাংশ ভূমি হচ্ছে মালভূমি, সমভূমি ও পাহাড়। দেশটির প্রায় ৫০% জনসংখ্যা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। কারণ প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এই দেশটি গৃহযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই দেশটিতে দুর্নীতির পাশাপাশি জঙ্গি, সন্ত্রাস, দুর্ভিক্ষ, গৃহযুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো সমস্যা রয়েছে। সোমালিয়া প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ হওয়ার পরেও দেশটির প্রায় ৬৫% মানুষ কৃষির সাথে যুক্ত। আফ্রিকার অন্যান্য দেশের মতো এই দেশটিতে খরা, বন্যা, এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। এছাড়াও সোমালিয়া সমগ্র বিশ্বের কাছে তাদের ভয়ঙ্কর জলদস্যুদের জন্য কুখ্যাত। বর্তমানে সোমালিয়ার মাথাপিছু জিডিপি প্রায় ৫৪৪ মার্কিন ডলার।
৫. মাদাগাস্কার
মাদাগাস্কার আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত একটি দ্বীপ রাষ্ট্র যা বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম দ্বীপ। দ্বীপটি প্রায় আড়াই মিলিয়ন বছর আগে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। দ্বীপটি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বন্যপ্রাণী, এবং সংস্কৃতির জন্য পরিচিত। মাদাগাস্কারের অর্থনীতি মূলত কৃষি এবং পর্যটন নির্ভর। চাল, আঁখ, কাসাভা, মিষ্টি আলু, শাক, কলা, আম, ভুট্টা, নারকেলসহ বৈচিত্র্যপূর্ণ কৃষি পন্য উৎপাদনের মাধ্যমে দেশটি নিজেদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে পারলেও দেশটির প্রায় ৭০% মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে। কৃষির পাশাপাশি অবশ্য পর্যটন ও খনিজ সম্পদ কিছুটা অবদান রাখে দেশটির অর্থনীতিতে। বর্তমানে দেশটির মাথাপিছু জিডিপি মাত্র ৫৪০ মার্কিন ডলার।
আরো জানুন: এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ১০টি দেশ
৪. মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র
মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র মধ্য আফ্রিকার স্থলবেষ্টিত একটি দেশ যা চাদ নদী ও কঙ্গো নদীর অববাহিকাদ্বয়ের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। এই দেশটিতে স্বর্ণ, হীরা, ইউরেনিয়াম ও অন্যান্য খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য প্রচুর পরিমাণে থাকা সত্ত্বেও একটি বিশ্বে অন্যতম একটি দেশ দরিদ্র দেশ। দেশটির ৭৪% এর বেশি মানুষ মূলত কৃষি কাজের সাথে জড়িত থাকলেও এখানকার মাটির যথেষ্ট উর্বর নয়। তবে দেশটি হীরা, তুলা, তক্তাকাঠ ও কফি রপ্তানি করে থাকে এবং এই দেশের মোট রপ্তানী আয়ের প্রায় ৩০% আসে হীরা রপ্তানির থেকে। অন্যান্য অনুন্নত দেশের মতো এই দেশটিও শীল্প খাতে তেমন উন্নতি সাধন করতে পারেনি। বর্তমানে দেশটির মাথাপিছু জিডিপি মাত্র ৫১৬ মার্কিন ডলার।
৩. মালাউই
মালাউই দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার একটি স্থলবেষ্টিত দেশ যা পূর্বে ন্যায়াসাল্যন্ড নামে পরিচিত ছিল। এটি একটি দরিদ্র দেশ যার প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এই দেশের অর্থনীতি মুলত কৃষির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এবং জনসংখ্যার প্রায় ৮৫% গ্রামীণ এলাকায় বাস করে। দেশটির ৮০ শতাংশেরও বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিকাজের উপরে নির্ভরশীল। দেশটির প্রধান কৃষিজ পণ্যগুলির মধ্যে রয়েছে তামাক, চা, ভুট্টা, এবং ময়দা। মালাউইয়ের প্রধান সমস্যাগুলির মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, এবং স্বাস্থ্য সমস্যা। এছাড়া প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণেও দেশটির অর্থনীতি বারবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বর্তমানে দেশটির মাথাপিছু জিডিপি মাত্র ৪৮৩ মার্কিন ডলার।
আরো জানুন: এশিয়ার সবচেয়ে ছোট ১০টি দেশ
২. সিয়েরা লিওন
সিয়েরা লিওন পশ্চিম আফ্রিকাতে আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে অবস্থিত একটি দেশ যার সাংবিধানিক নাম সিয়েরা লিওন প্রজাতন্ত্র। দেশটির রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর ফ্রিটাউন। সিয়েরা লিওনের অর্থনীতি মূলত খনিজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল, বিশেষ করে হীরা কিন্তু সরকারের দুর্নীতি ও প্রাকৃতিক সম্পদের অব্যবস্থাপনার ফলে এতো প্রাকৃতিক সম্পদ থাকার পরেও সিয়েরা লিওনের ৭০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমাযর নিচে বসবাস করে। জলবায়ুর পরিবর্তন, রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি প্রাকৃতিক দূর্যোগও সিয়েরা লিওনের বর্তমান অর্থনৈতিক দূরাবস্থার জন্য অনেকাংশে দায়ী। বর্তমানে দেশটির মাথাপিছু জিডিপি মাত্র ৪৭২ মার্কিন ডলার।
১. বুরুন্ডি
বুরুন্ডি বিশ্বের সবচেয়ে গরিব দেশ যা পূর্ব আফ্রিকার একটি স্থলবেষ্টিত ছোট্ট দেশ। কৃষিপ্রধান এই দেশটি দুর্নীতি, গৃহযুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অধিক জনসংখ্যার কারণে আর্থিকভাবে অসচ্ছল। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৮০% দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। এছাড়া জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে দেশিটির প্রধান আয়ের উৎস কৃষিখাতেও। বর্তমানে বুরুন্ডির মাথাপিছু জিডিপি মাত্র ৩০৮ মার্কিন ডলার যা বিশ্বের সর্বনিম্ন। তাই বুরুন্ডির অর্থনীতি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও উন্নত দেশের সাহায্য ও ঋণের উপরে নির্ভরশীল। বুরুন্ডির সরকার দারিদ্র্য দূর করার জন্য কাজ করছে, তবে বুরুন্ডিকে দারিদ্র্য থেকে বের করতে হলে এর রাজনৈতিক অস্থিরতা, জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার সুযোগগুলি উন্নত করতে হবে।
এছাড়াও যদি আপনি নিয়মিত বিশ্বের ছোট ছোট অদ্ভুত, রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক বিষয় সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত থাকুন।
ফেইসবুক পেইজ:
ইউটিউব চ্যানেল:
ইনস্টাগ্রাম পেজ: The Earth Bangla
ফেইসবুক গ্রুপ:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not Enter any spam comment or Link in the comment Box