এশিয়ার বৃহত্তম ১০টি অর্থনীতি
একবিংশ শতাব্দীকে প্রায়শই এশিয়ান শতাব্দী হিসাবে উল্লেখ করা হয়। ম্যাককিন্সি থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২১ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এশিয়া বিশ্বের মোট জিডিপিতে ৫০% এর বেশি অবদান রাখতে পারে। জিডিপি একটি দেশের অভ্যন্তরে এক বছরে উৎপাদিত সকল দ্রব্য ও সেবা বাজারের মূল্যের সমষ্টি যা তার অর্থনীতির আকার পরিমাপ করে। বিশ্বের কিছু দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির আবাসস্থল এশিয়া হওয়ায় মহাদেশটি বিশ্বের ভবিষ্যত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। The Earth Banglar সেরা ১০ সিরিজের আজকের পর্বে আমরা আপনাদের জানাবো মোট জিডিপির ভিত্তিতে এশিয়ার সবচেয়ে বড় ১০টি অর্থনীতি সম্পর্কে।
১০.থাইল্যান্ড
থাইল্যান্ডের অর্থনীতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ এবং দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি।এর কৃষি খাত থাইল্যান্ডের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় খাত যার উপর ৪০% মানুষ নির্ভরশীল। এর প্রধান কৃষিজ পণ্যগুলির মধ্যে রয়েছে চাল, ধান, লবণ, মাছ এবং ফল।সাথে শিল্প ও পরিষেবা খাতও বড় ভূমিলা পালন করায় এর অর্থনীতি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। এখানে স্থিতিশীল গণতন্ত্র, দক্ষ শ্রমশক্তি,ও ভৌগোলিক অবস্থান বিদেশী বিনিয়োগ এবং ব্যবসায়িক বৃদ্ধিতে প্রসার ঘটায়। যেকারনে দেশটি ব্যাবসা-বানিজ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। তাছাড়া এখানকার উর্বর জমি,বন ও খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। থাইল্যান্ডের জিডিপি প্রায় ৫৭৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
৯. সিঙ্গাপুর
পূর্বে সিঙ্গাপুর ছিলো বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে একটি। এর জাতির পিতা লি কুয়ান ইউ দূরদর্শী নেতৃত্বের অধীনে দেশটির একটি অর্থনৈতিক বিপ্লব শুরু হয়। দূর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থার সংস্করণ ও অবকাঠামোতে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করে তিনি দেশের অর্থনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেন। এর ভৌগোলিক অবস্থান ও ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ প্রচুর বিদেশী বিনিয়োগ এবং ব্যবসায়িদের আকর্ষন করে এবং যেকারণে সিঙ্গাপুরের অর্থনীতি আজ বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশগুলির মধ্যে একটি। দেশটিতে একটি অত্যন্ত উন্নত পর্যটন খাত রয়েছে, প্রতি বছর মিলিয়ন মিলিয়ন দর্শক আসে। প্রায় ৬৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জিডিপি নিয়ে এটি এশিয়ায় ৯ম বৃহত্তম অর্থনীতি।
৮.তাইওয়ান
চীনের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন তাইওয়ান মূলত দক্ষিণ চীন সমূদ্রের একটি দ্বীপ। এর আয়তন মাত্র ৩৫,৮০৮ বর্গ কিলোমিটার হলেও এর অর্থনীতি এশিয়ার মধ্যে অন্যতম। ১৯৬০ দশকের শুরু থেকে তাইওয়ান দ্রুত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও শিল্পায়ন করতে থাকে যা "তাইওয়ান মিরাকেল" নামে পরিচিত। শিল্প খাত হল তাইওয়ানের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি যা কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কৃষিখাতে তাইওয়ান পিছিয়ে থাকলেও দেশটি সারাবিশ্বে প্রচুর পরিমানে উচ্চমানের প্রযুক্তি রপ্তানি করে সুপরিচিত লাভ করেছে। এর জিডিপির পরিমান প্রায় ৭৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
আরো জানুন: এশিয়ার সবচেয়ে উন্নত ১০টি দেশ
৭.তুরস্ক
তু্রস্ক মুসলিম বিশ্বে অন্যতম প্রভাবশালী দেশ। এটি এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায় ব্যাবসা-বানিজ্য ও বিনিয়োগের প্রধান মাধ্যম হিসাবে কাজ করছে। কৃষি পণ্য, টেক্সটাইল, মোটর যান, পরিবহন সরঞ্জাম, নির্মাণ সামগ্রী, এবং গৃহস্থালী যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী শীর্ষস্থানীয় দেশগুলির মধ্যে তুরস্ক একটি। টেক্সটাইল ও বস্ত্রশিল্প এর রপ্তানির প্রধান উৎস। দেশটি গ্যাস ও জ্বালানি তেলের জন্য নির্ভরশীল হলেও কৃষ্ণসাগরে জ্বালানি গ্যাসের মজুত আবিষ্কার অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা যোগাচ্ছে। তবে সাম্প্রতি ভূমিকম্প ও তীব্র মুদ্রাস্ফীতির কারনে দেশটির অর্থনীতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। তুরস্কের জিডিপি প্রায় ১.০২৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
৬. সৌদি আরব
সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ যা বিশ্বের বৃহত্তম তেল রপ্তানিকারক। দেশটির অর্থনীতি তেলের উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল, যা মোট জিডিপিতে প্রায় ৮০% অবদান রাখে। বিশ্বে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে ২০২২ সালে এর অর্থনীতি ৮.৭% বৃদ্ধি পায় জি-২০ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে এর বেশিরভাগ জায়গা মরুভূমি হওয়ায় সৌদি আরব চাষাবাদের ক্ষেত্রে সুবিধা করতে পারেনি। তেলের দামের ওঠানামার সাথে এর অর্থনীতি গতি নির্ভর করার কারনে দেশটির সরকার এই খাতের প্রতি নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে চাচ্ছে। তাই তারা বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও নতুন শিল্প ও বানিজ্যের প্রসারে কাজ করছে। প্রায় ১.০৬১ ট্রিলিয়ন জিডিপি নিয়ে এটি এশিয়ার ৬ষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতি।
৫. ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের ৫ম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ যা অসংখ্য দ্বীপ নিয়ে গঠিত। এটি দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি যা মূলত কৃষির উপর নির্ভরশীল। মোট জনসংখ্যার ৪০ ভাগই কৃষিখাতে নিযুক্ত।এখানে প্রচুর পরিমানে জ্বালানি গ্যাস,কয়লা, তেল ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদের সমাহার রয়েছে। জনসংখ্যার ৯% দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করলেও এই হার ক্রমেই কমতির দিকে যাচ্ছে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেনীদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। উর্বর মাটি ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যের কারনেই এর অর্থনীতি এশিয়ার মধ্যে এত শক্তিশালী। দেশটির জিডিপি ১.৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার যা এশিয়ার মধ্যে ৫ম।
আরো জানুন: এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ১০টি দেশ
৪. দক্ষিণ কোরিয়া
১৯৫০ এর দশকে, দক্ষিন কোরিয়া ছিল একটি দরিদ্র এবং বিধ্বস্ত দেশ। কিন্তু সরকার এর দক্ষ জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে এর শিল্প ও প্রযুক্তি শীর্ষে উঠে আসে। এখন দেশটি বিশ্বের বৃহত্তম ইলেকট্রনিক্স রপ্তানিকারক যেখানে সামসাং,এলজি, হুন্দাইয়ের মতো নামকরা কম্পানির রাজত্ব রয়েছে। বর্তমানে জাহাজ নির্মানেও নেতৃত্ব দিচ্ছে দক্ষিন কোরিয়া। এর জিডিপি প্রায় ১.৭২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার যা এশিয়ার মধ্যে চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি। এখানে অর্থনীতির প্রধান খাত হল শিল্প, যা জিডিপির প্রায় ৩৫% অবদান রাখে। তবে দক্ষিন কোরিয়ান বিগত কয়েক দশক ধরে জনসংখ্যা আশংকাজনক ভাবে হ্রাস পাচ্ছে যা এর অর্থনীতির জন্য হুমকির কারন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
৩. ভারত
ভারত দক্ষিন এশিয়ার একটি দেশ যা বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। এটি একটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ যার ৫৮% জনসংখ্যাই কৃষির উপর নির্ভরশীল।ভারত বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পাট, ডাল ও দুধ উৎপাদন করে থাকে। এখানে প্রচুর পরিমানে কয়লা, লোহা, প্রাকৃতিক গ্যাস ইত্যাদি খনিজ সম্পদ রয়েছে। দেশটি তার বিশাল জনবল ও প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ হিসাবে গড়ে উঠেছে। ভারতে মোট জিডিপির পরিমান প্রায় ৩.৭৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার যা এশিয়ায় ৩য় ও বিশ্বে ৫ম বৃহত্তম অর্থনীতি। তবে ধারণা করা হচ্ছে ভারতের বিশাল জনগোষ্ঠীকে সম্পদে পরিনত করতে পারলে ২০২৭ সালের মধ্যে এর অর্থনীতি জার্মানি ও জাপানকে ছাড়িয়ে যাবে।
২.জাপান
সূর্যোদয়ের দেশ জাপান এশিয়ার ২য় বৃহত্তম এবং পুরো বিশ্বে ৩য় বৃহত্তম অর্থনীতি। তেমন কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকলেও জাপানের মানুষ মেধা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে এই শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তুলেছে। মোটরগাড়ি,যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রনিকস ইত্যাদি রপ্তানির মাধ্যমে এটি বিশ্বের ২য় রপ্তানিকারক দেশ হয়ে উঠেছে। এখানে কৃষিজমির পরিমান অনেক কম হলেও জাপান আধুনিক যন্ত্রপাতি ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে উচ্চ উৎপাদনশীলতা আনতে সক্ষম হয়েছে। টয়োটা, সনি, হিটাচির মত জাপানে বড় বড় কোম্পানিগুলো পুরো বিশ্বে রাজত্ব করছে। দেশটির জিডিপি প্রায় ৪.৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার যার এক-তৃতীয়াংশই রপ্তানি থেকে আসে।
আরো জানুন: এশিয়ার সবচেয়ে ছোট ১০টি দেশ
১. চীন
চীন একটি পূর্ব এশিয়ার দেশ যা এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি। চীনের রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর হল বেইজিং। ২০২৩ সালের হিসাবে, চীনের মোট জিডিপি প্রায় ১৯.৩৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। চীনের কিছু প্রধান অর্থনৈতিক খাতগুলির মধ্যে রয়েছে উৎপাদন, নির্মাণ, কৃষি এবং পরিষেবা। ইলেকট্রনিক্স এর বৃহত্তম রপ্তানি পণ্য যা মোট রপ্তানির প্রায় ৩০% গঠন করে। ধান বিশ্বের অর্ধেক মানুষের প্রধান খাদ্য যার বেশিরভাগ অংশই আসে চীন থেকে। চীন বিশ্বের বৃহত্তম রপ্তানিকারক যেখানে যুক্তরাষ্টের পরেই জিডিপি এবং ক্রয়ক্ষমতার দিক দিয়ে চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। ২০০১ সালে এটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য পদ লাভ করে। গত কয়েক দশকে এখানে দ্রুত শিল্পায়ন, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং বিশাল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে।
এছাড়াও যদি আপনি নিয়মিত বিশ্বের ছোট ছোট অদ্ভুত, রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক বিষয় সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত থাকুন।
ফেইসবুক পেইজ:
ইউটিউব চ্যানেল:
ইনস্টাগ্রাম পেজ: The Earth Bangla
ফেইসবুক গ্রুপ:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not Enter any spam comment or Link in the comment Box