ইউরোপের শীর্ষ ১০টি ক্ষুদ্রতম দেশ
ইউরোপ বিশ্বের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম মহাদেশ যা আয়তনে এশিয়া মহাদেশের প্রায় ৫ ভাগের ১ ভাগ। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই মহাদেশের মোট ৫০টি দেশের মধ্যে অধিকাংশ দেশই আয়তনে ছোট কিন্তু ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক থেকে দেশগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির নিদর্শন মিলে এই মহাদেশ থেকেই। The Earth Banglar সেরা ১০ সিরিজের আজকের পর্বে আমরা আপনাদের জানাবো আয়তনে ইউরোপের সবচেয়ে ছোট ১০টি দেশ সম্পর্কে।
১০. উত্তর মেসিডোনিয়া
উত্তর মেসিডোনিয়া ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্বে বলকান উপদ্বীপে অবস্থিত একটি স্থলবেষ্টিত দেশ যা তার বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের জন্য পরিচিত। দেশটির আয়তন ২৫ হাজার ৭১৩ বর্গকিলোমিটার যা ইউরোপের দশম ক্ষুদ্রতম দেশ। কসোভো, সার্বিয়া, বুলগেরিয়া, গ্রীস এবং আলবেনিয়ার সাথে দেশটির স্থল সীমানা রয়েছে। ১৯৯১ সালে উত্তর মেসিডোনিয়া যুগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। বর্তমানে এটি একটি উন্নয়নশীল দেশ যার অর্থনীতি মূলত কৃষি, ধাতু ও ধাতব পণ্য এবং টেক্সটাইল খাতের ওপর নির্ভরশীল। দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ১৮ লক্ষ এবং এর রাজধানীর নাম স্কপিয়ে যা অটোমান এবং ইউরোপীয় স্থাপত্যের মিশ্রণের জন্য বিখ্যাত।
৯. স্লোভেনিয়া
স্লোভেনিয়া মধ্য ইউরোপে অবস্থিত একটি ছোট দেশ যার আয়তন ২০ হাজার ২৭১ বর্গকিলোমিটার। এটি ইউরোপের নবম ক্ষুদ্রতম দেশ যা পশ্চিমে ইতালি, উত্তরে অস্ট্রিয়া, উত্তর-পূর্বে হাঙ্গেরি, দক্ষিণ-পূর্বে ক্রোয়েশিয়া এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে অ্যাড্রিয়াটিক সাগর দ্বারা বেষ্টিত। স্লোভেনিয়ার একটি দীর্ঘ এবং সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। দেশটিতে প্রাচীন গ্রীক, রোমান এবং বাইজেন্টাইন সভ্যতার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ১৯১৮ সালে স্লোভেনিয়া যুগোস্লাভিয়ার অংশ ছিল এবং ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। স্লোভেনিয়ার রাজধানী লিউব্লিয়ানা যা প্রায় ১০০০ বছরেরও বেশি পুরানো শহর। প্রায় ২১ লক্ষ জনসংখ্যার এই দেশটি বর্তমানে একটি উন্নত অর্থনীতির দেশ এবং Human Development Index বা HDI সূচকে দেশটির অবস্থান বিশ্বে ২৩ তম।
আরো জানুন: ইউরোপের সবচেয়ে বড় ১০টি দেশ
৮. মন্টিনিগ্রো
মন্টিনিগ্রো ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্বে বলকান অঞ্চলে অবস্থিত একটি দেশ যা পূর্বে যুগোস্লাভিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯২ সালে যুগোস্লাভিয়ার ভাঙ্গনের সময় সার্বিয়া মন্টিনিগ্রোর সাথে একটি ইউনিয়ন গঠন করে। তবে এই ইউনিয়নটি দীর্ঘ সময়ের জন্য স্থায়ী হয়নি। ২০০৬ সালের মে মাসে মন্টিনিগ্রো ও সার্বিয়ার মধ্যে অনুষ্ঠিত গণভোটে মন্টিনিগ্রোর জনগণ দেশটির স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়। বর্তমানে মন্টিনিগ্রো একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ যার আয়তন ১৩ হাজার ৮১২ বর্গকিলোমিটার এবং এটি ইউরোপের অষ্টম ক্ষুদ্রতম দেশ। দেশটির বেশিরভাগ অংশ পর্বতমালা দ্বারা আচ্ছাদিত তবে দক্ষিণ-পশ্চিমে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের সাথে ছোট সমভূমি রয়েছে। দেশটির রাজধানী পোদগোরিচা এবং জনসংখ্যা প্রায় ৬ লক্ষ। মন্টিনিগ্রোর অর্থনীতি মূলত পর্যটন ও কৃষি নির্ভর। দেশটিতে অনেক সুন্দর সমুদ্র সৈকত রয়েছে যা বিশ্বের জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য।
৭. লুক্সেমবার্গ
২ হাজার ৫৮৬ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে লুক্সেমবার্গ ইউরোপের সপ্তম ক্ষুদ্রতম দেশ। পশ্চিম ইউরোপে অবস্থিত এই স্থলবেষ্টিত দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ। দেশটির রাজধানীর নাম লুক্সেমবার্গ সিটি এবং জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ। আয়তন ও জনসংখ্যা উভয় দিক থেকে ছোট হলেও দেশটি উচ্চ আয় এবং নিম্ন বেকারত্বের হারের জন্য পরিচিত। লুক্সেমবার্গ বিশ্বের অন্যতম গতিশীল অর্থনীতির দেশ যা মূলত ব্যাংকিং, স্টীল এবং শিল্প খাতের উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও লুক্সেমবার্গ ইউরোপের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। ২০২২ এর ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট অনুযায়ী লুক্সেমবার্গ বিশ্বের অষ্টম সুখী দেশ এবং HDI সূচকে দেশটির অবস্থান ১৭ তম।
৬. অ্যান্ডোরা
অ্যান্ডোরা দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের একটি স্থলবেষ্টিত দেশ যা পিরিনীয় পর্বতমালার পূর্ব অংশে অবস্থিত। এটি একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দেশ যা ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হল অ্যান্ডোরা একটি স্বাধীন দেশ হলেও এই দেশটিকে পরিচালনা করে ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি এবং স্পেনের উর্গেল অঞ্চলের বিশপ। বর্তমানে এটি ইউরোপের ষষ্ঠ ক্ষুদ্রতম দেশ যার আয়তন মাত্র ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার। দেশটির রাজধানী অ্যান্ডোরা লা ভেয়য়া এবং জনসংখ্যা প্রায় ৮১ হাজার। অ্যান্ডোরার অর্থনীতি মূলত পর্যটন নির্ভর। দেশটিতে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক ঘুরতে আসে। এছাড়া অ্যান্ডোরা বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ আয়ুর দেশ হিসেবে পরিচিত যেখানে একজন সাধারণ মানুষের গড় আয়ু ৮৩ বছর।
আরো জানুন: আফ্রিকার সবচেয়ে বড় ১০টি দেশ
৫. মাল্টা
বিশ্বের দশম এবং ইউরোপের পঞ্চম ক্ষুদ্রতম দেশ মাল্টা যার আয়তন মাত্র ৩১৬ বর্গকিলোমিটার। এটি ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত ৫ টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত একটি ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র। দেশটির প্রধান ৩ টি দ্বীপ হল - মাল্টা, গজো এবং কমিনো। মূলত এই তিনটি দ্বীপকে ঘিরে দেশটির জনবসতি গড়ে উঠেছে। মাল্টার জনসংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষের অধিক এবং দেশটির রাজধানী ও বৃহত্তম শহর হল ভাল্লেত্তা। পূর্বে মাল্টা ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থাকা একটি অঞ্চল ছিল এবং ১৯৬৪ সালে এটি ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। মাল্টার অর্থনীতি পর্যটন খাতের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অসাধারণ স্থাপত্য এবং মনোমুগ্ধকর আবহাওয়ার কারনে এই দেশটি সকল শ্রেণির ভ্রমনপিপাসুদের জন্য অন্যতম আকর্ষণ।
৪. লিশটেনস্টাইন
লিশটেনস্টাইন মধ্য ইউরোপে অবস্থিত একটি ছোট দেশ যার আয়তন মাত্র ১৬০ বর্গকিলোমিটার। আয়তনের বিচারে এটি বিশ্বের ষষ্ঠ এবং ইউরোপের চতুর্থ ক্ষুদ্রতম দেশ। এটি আল্পস পর্বতমালার অভ্যন্তরে রাইন নদীর উপত্যকার একটি অংশে অবস্থিত। লিশটেনস্টাইন ইউরোপের একমাত্র Double Landlocked Country। অর্থাৎ এটি এমন একটি দেশ যা নিজে স্থলবেষ্টিত এবং এর প্রতিবেশী দেশগুলোও স্থলবেষ্টিত। অস্ট্রিয়া এবং সুইজারল্যান্ডের মাঝে অবস্থিত এই দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ৩৯ হাজার এবং দেশটির রাজধানী ফাডুৎস। বর্তমানে লিশটেনস্টাইন বিশ্বের সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয়ের দেশ। দেশটির অর্থনীতি মূলত ব্যাংকিং, শিল্প এবং পর্যটন নির্ভর।
৩. সান মারিনো
মাত্র ৬১ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে সান মারিনো বিশ্বের পঞ্চম এবং ইউরোপের তৃতীয় ক্ষুদ্রতম দেশ। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম সার্বভৌম রাষ্ট্র যার সংবিধান ১৬০০ সালে প্রণীত হয়েছিল। ক্ষুদ্র এই দেশটি পুরোপুরি ইতালি দ্বারা বেষ্টিত। দেশটির রাজধানীর নাম সান মারিনো সিটি এবং জনসংখ্যা প্রায় ৩৩ হাজার। সান মারিনো বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর মধ্যে একটি। দেশটির অর্থনীতি সিরামিক, টাইলস, আসবাবপত্র এবং ওয়াইন তৈরির উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও এই দেশটি বিশ্বের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ যা এর অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখে। মজার ব্যাপার হল সান মারিনো পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে মানুষের তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
আরো জানুন: বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০টি দেশ
২. মোনাকো
আয়তনে ইউরোপের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম দেশ মোনাকো যার আয়তন মাত্র ২ বর্গকিলোমিটার। দেশটি ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত। আয়তনে ছোট হলেও এই দেশটিতে প্রায় ৩৯ হাজার মানুষের বসবাস এবং এটি পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। দেশটির অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি হল ব্যাংকিং এবং পর্যটন। তবে মোনাকোর প্রধান আকর্ষণ হল মন্টে কার্লো ক্যাসিনো যা পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় ক্যাসিনো হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও মোনাকো ট্যাক্স হেভেন হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে। দেশটির জনগনকে কোন আয়কর দিতে হয়না এবং এখানে ব্যবসায়িক করের পরিমাণ খুবই কম। ক্ষুদ্র এই দেশটি বিত্তশালী শ্রেণির ব্যক্তিদের জন্য বিনোদন এবং বিলাসিতার একটি আদর্শ গন্তব্য।
১. ভ্যাটিকান সিটি
ভ্যাটিকান সিটি শুধুমাত্র ইউরোপ মহাদেশ নয়, এটি বিশ্বের সবচেয়ে ছোট দেশ যার আয়তন মাত্র ০.৪৯ বর্গকিলোমিটার বা ১২১ একর। এটি ইতালির রাজধানী রোম শহরের ভিতরে অবস্থিত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। শুধুমাত্র আয়তনের দিক থেকে নয়, ১০০০ এর কাছাকাছি জনসংখ্যা নিয়ে এটি বিশ্বের সবচেয়ে কম জনসংখ্যার দেশ। আয়তনে ছোট হলেও দেশটির নিজস্ব পোস্ট অফিস, রেডিও স্টেশন এবং টেলিভিশন সম্প্রচার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও বিশ্বের বৃহত্তম গির্জা সেন্ট পিটারস ব্যাসিলিকা ভ্যাটিকান সিটিতে অবস্থিত। ভ্যাটিকান সিটির রাষ্ট্রপ্রধান হলেন পোপ। পোপ হলেন ক্যাথলিক চার্চের প্রধান এবং খ্রিস্টান বিশ্বের আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভ্যাটিকান সিটির আয় মূলত ডাকটিকেট, কয়েন, পদক এবং দর্শনার্থীদের কাছে বিক্রি করা স্বারকচিহ্ন এবং প্রকাশনাসত্বর থেকে আসে। তবে ব্যাংক নোট, স্ট্যাম্প এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসের জন্য দেশটি ইতালির ওপর নির্ভরশীল।
এছাড়াও যদি আপনি নিয়মিত বিশ্বের ছোট ছোট অদ্ভুত, রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক বিষয় সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত থাকুন।
ফেইসবুক পেইজ:
ইউটিউব চ্যানেল:
ইনস্টাগ্রাম পেজ: The Earth Bangla
ফেইসবুক গ্রুপ:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not Enter any spam comment or Link in the comment Box