বিশ্বের সবচেয়ে অনুন্নত ১০টি দেশ
অনুন্নত দেশ বলতে আমরা সে সকল দেশের বুঝি, যে সকল দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, অর্থনীতি, অবকাঠামো ও জনসংখ্যা সংক্রান্ত যাবতীয় সূচক নিম্নে অবস্থান করে। বিশ্বের বেশিরভাগ উন্নত দেশ যেখানে ইউরোপ মহাদেশে অবস্থিত, সেখানে অনুন্নত দেশগুলোর বেশিরভাগই রয়েছে আফ্রিকা মহাদেশে। অনুন্নত দেশগুলোর জনগণ সাধারণত পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত বিভিন্ন অভাবে ভোগেন এবং শিক্ষার হার অনেক কম থাকে। এছাড়া অধিকাংশ অনুন্নত দেশগুলোর অর্থনীতি ভঙ্গুর এবং তারা পরিবেশগত নানা চ্যালেঞ্জের মুখে থাকে। প্রতি ১০ বছর পর পর জাতিসংঘের এলডিসি অনুষ্ঠিত সম্মেলনে অনুন্নত দেশের তালিকা প্রকাশ করা হয়। The Earth Banglar সেরা ১০ সিরিজের আজকের পর্বে আমরা আপনাদের জানাবো HDI স্কোরের ভিত্তিতে বিশ্বের সবচেয়ে অনুন্নত ১০টি দেশ সম্পর্কে।
১০. গায়না
গায়না দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত একটি দেশ। এটি পূর্বে একটি ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল এবং তখন এর নাম ছিল ব্রিটিশ গায়ানা। দেশটিতে বেশিরভাগ মানুষ চরম দারিদ্রের শিকার, যার ফলে নানাবিধ রোগ ও অপুষ্টি দেশটির মানুষের কাছে যেন স্বাভাবিক এক ব্যাপার। দেশটির অর্থনীতি মূলত কৃষির উপরে নির্ভরশীল হলেও দেশটির মাটি কিন্তু তেমন উর্বর নয়। এছাড়া খরা ও বন্যার কারণে ফসলের ব্যপক ক্ষতি সাধণ হয় প্রায়ই। আফ্রিকার অন্যান্য দেশের তুলনায় গায়নার রাজনৈতিক ইতিহাস বেশ শান্তিপূর্ণ। তবে, আশেপাশের দেশগুলির রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য অনেক রিফিউজি পাড়ি জমিয়েছে এই দেশটিতে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও জীবনযাত্রার মান সব মিলিয়ে দেশটি ০.৪৬৫ HDI স্কোর নিয়ে বিশ্বের অনুন্নত দেশের তালিকায় দশম স্থানে রয়েছে।
৯. ইয়েমেন
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম দরিদ্র দেশ ইয়েমেন যা আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে অবস্থিত একটি দেশ। এটি ইয়েমেন মধ্যপ্রাচ্যের একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ যা ০.৪৫৫ HDI স্কোর নিয়ে বিশ্বের অনুন্নত দেশের তালিকায় নবম স্থানে রয়েছে। সুপেয় পানিসহ মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ জিনিষই এই দেশটিতে পর্যাপ্ত পরিমানে নেই। দেশটির আর্থ সামাজিক অবস্থা বারবার বাধাগ্রস্থ হয় রাজনৈতিক নানা অস্থিরতার জন্য। ১৯৯০ সাল থেকে চলে আসা হুতী বিদ্রোহ সহ রাজনৈতিক পালাবদল দেশটির উন্নতির পথে বড় বাধা। এসব কিছু বিরূপ প্রভাব ফেলেছে দেশটির সামগ্রিক জীবন মানের উপরে। এছাড়া দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের ফলে দেশটির একটি বড় অংশ দুর্ভিক্ষের কবলে রয়েছে।
আরো জানুন: এশিয়ার সবচেয়ে উন্নত ১০টি দেশ
৮. বুরকিনা ফাসো
বুরকিনা ফাসো পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ যা পূর্বে আপার ভোল্টা নামে পরিচিত ছিল। আফ্রিকার অন্যতম দরিদ্র এই দেশটি বিখ্যাত সাহারা মরুভূমির একেবারে সংলগ্নে অবস্থিত। দেশটিতে প্রধান পেশা কৃষি হলেও স্বর্ণ উৎপাদনে বুরকিনা ফাসো আফ্রিকা মহাদেশে ৫ম অবস্থানে আছে। কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা সমস্যার কারণে প্রাকৃতিক সম্পদের এই প্রাচুর্যকে কাজে লাগাতে পারছে না দেশটি। বুরকিনা ফাসো খরাপ্রবণ তৃণভূমি নিয়ে গঠিত এবং মাটির মান খারাপ। তবুও দেশের অর্থনীতি কৃষির উপর নির্ভরশীল। তাই প্রতি বছর এই দেশের হাজার হাজার লোক পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতে মৌসুমী কৃষিকাজের জন্য পাড়ি জমায়। এসব কিছুর সম্মিলিত প্রভাব পড়েছে দেশটির নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানের উপরে আর তাই, দেশটির HDI স্কোর ০.৪৪৯ যা বিশ্বের ৮ম অনুন্নত দেশ।
৭. মোজাম্বিক
মোজাম্বিক আফ্রিকার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত একটি দেশ যা পূর্বে একটি পর্তুগিজ উপনিবেশ ছিল। এটি বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র এবং সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলির মধ্যে একটি। দেশটির HDI স্কোর ০.৪৪৬ যা বিশ্বের ৭ম অনুন্নত দেশ। দেশটির অর্থনীতি মূলত কৃষির উপর নির্ভরশীল, কিন্তু শিল্প এবং পর্যটন খাতও প্রসারিত হচ্ছে। মোজাম্বিক ব্যাপক প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ তবে সরকারি উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনার দূর্বলতার জন্য দেশটির অধিকাংশ মানুষ দারিদ্রের সাথে লড়াই করে দিন কাটায়। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাও পর্যাপ্ত নেই এই দেশে যা এই দেশটির জনগণের জীবনযাত্রার মানকে ব্যাহত করে।
৬. মালি
মালি পশ্চিম আফ্রিকার একটি স্থলবেষ্টিত দেশ যার সরকারি নাম মালি প্রজাতন্ত্র। একসময় প্রবল পরাক্রমে পৃথিবীময় বিভিন্ন ভূমি দখল করে বেড়ানো ধনী এই দেশটি বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে অনুন্নত দেশের তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। দেশটির HDI স্কোর ০.৪২৮ এবং দেশটির প্রায় ৪২% জনসংখ্যা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। বন্যা কিংবা খরার মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশটির অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়াও সন্ত্রাসবাদ এবং সশস্ত্র সংঘাতের কারণে দেশটি নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে রয়েছে, যা মালির অর্থনীতিকে ব্যাহত করেছে এবং দেশটির নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান হ্রাস পেয়েছে।
আরো জানুন: বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ১০টি দেশ
৫. বুরুন্ডি
বুরুন্ডি পূর্ব আফ্রিকায় অবস্থিত একটি স্থলবেষ্টিত দেশ যা মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্রতম দেশ হিসেবে পরিচিত। পাশাপাশি ০.৪২৬ HDI স্কোর নিয়ে বুরুন্ডি বিশ্বের ৫ম অনুন্নত দেশ। দেশটি ১৯৬২ সালে স্বাধীনতার পূর্বে বেলজিয়ামের অধীনে ছিল। কৃষিপ্রধান এই দেশটি দুর্নীতি, গৃহযুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অধিক জনসংখ্যার কারণে আর্থিকভাবে অসচ্ছল। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৮০% দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এদেশের আবহাওয়াকে বসবাসের আরও অনুপযোগী করে তুলেছে। শিক্ষাখাত ও স্বাস্থ্যসেবার দূরবস্থার সাথে তীব্র দারিদ্রতার জন্য দেশটির সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার মান ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
৪. মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র
মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র মধ্য আফ্রিকার স্থলবেষ্টিত একটি দেশ যা চাদ নদী ও কঙ্গো নদীর অববাহিকাদ্বয়ের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। আফ্রিকার দরিদ্র এই দেশটিতে স্বর্ণ, হীরা, ইউরেনিয়াম ও অন্যান্য খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য প্রচুর পরিমাণে থাকা সত্ত্বেও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর আক্রমণ ও পারস্পরিক দাঙ্গার কারণে দেশটির স্থিতিশীলতা চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। দেশটির অধিকাংশ মানুষ মূলত কৃষি কাজের সাথে জড়িত থাকলেও এখানকার মাটির যথেষ্ট উর্বর নয় যার ফলে দেশটি পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন করতে পারে না। এছাড়াও দুর্বল অবকাঠামো, সরকারের অব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে দেশটির জনগণের জীবন যাত্রার মান বিশ্বে বিশ্বের নিম্নতর। সব মিলিয়ে দেশটি ০.৪০৪ HDI স্কোর নিয়ে বিশ্বের অনুন্নত দেশের তালিকায় চতুর্থ স্থানে রয়েছে।
৩. নাইজার
নাইজার পশ্চিম আফ্রিকার স্থলবেষ্টিত একটি দেশ যার নাম রাখা হয়েছে নাইজার নদীর নামানুসারে। দেশটির প্রায় ৪৪% জনসংখ্যা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে এবং বিশ্বের অনুন্নত দেশের তালিকায় একটি তৃতীয় স্থানে রয়েছে যার HDI স্কোর ০.৪০০০। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ নাইজারে প্রচুর পরিমাণে তেল, গ্যাস, ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ রয়েছে। তবে, দীর্ঘ দিন ধরে চলা রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য দেশটি তাদের এই প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনতে পারেনি। এছাড়াও দূর্বল স্বাস্থব্যবস্থা, শিক্ষার অভাব ও দরিদ্র নাগরিকের সংখ্যা বেশি হওয়ায় দেশটির সাধারণ জনগণের জীবন যাত্রার মান অত্যান্ত নিম্নতর।
আরো জানুন: এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ১০টি দেশ
২. চাদ
চাদের মধ্য আফ্রিকার একটি স্থলবেষ্টিত দেশ যার সরকারি নাম চাঁদ প্রজাতন্ত্র। এই দেশটিকে আফ্রিকার মৃত হৃদয় বলা হয় কারণ দেশটি একটি বড় মরুভূমি দ্বারা আচ্ছাদিত। একটি বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ যেখানে প্রায় ৮০% জনসংখ্যা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এছাড়াও HDI স্কোরের ভিত্তিতে এটি বিশ্বের দ্বিতীয় অনুন্নত দেশ যার স্কোর ০.৩৯৪। দুর্বল অর্থনীতি, স্বাস্থব্যবস্থা, অবকাঠামো, শিক্ষার অভাব এবং সরকারের অব্যবস্থাপনা দেশটিকে বসবাসের অনুপযোগী করে তুলেছে। ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া, টিবি’র মতো মহামারি নিয়ন্ত্রণে প্রায় প্রতি বছর জুড়েই হিমশিম খেতে হয় এই দেশের সরকারকে যা এদেশের জনগণের নিম্ন জীবন মানের ধারণা দেয়।
১. দক্ষিণ সুদান
দক্ষিণ সুদান বিশ্বের সবচেয়ে অনুন্নত দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় যা পূর্ব-মধ্য আফ্রিকায় অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র দেশ। দেশটির HDI স্কোর মাত্র ০.৩৮৫ এবং দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে। এটি ২০১১ সালে সুদান থেকে আলাদা হয়ে একটি স্বাধীন দেশে পরিণত হয় এবং দেশটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সরকারি অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি সহ নানান সমস্যায় জর্জরিত। এখানে শিক্ষার হার ও জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত নিম্ন। এছাড়া দেশটিতে স্বাস্থব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল, যেখানে প্রায় প্রতি ১০ হাজার জনের জন্য রয়েছে মাত্র একজন ডাক্তার। দক্ষিণ সুদানের অর্থনীতির ভিত্তি হল কৃষি এবং এই দেশটির অর্থনীতি বিশ্বের সবচেয়ে অনুন্নত অর্থনীতিগুলির মধ্যে একটি। বর্তমানে ১২ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই দেশটি নিজেদের অফুরন্ত খনিজ সম্পদ থাকার পরেও বিভিন্ন দাতা সংস্থার সাহায্যের উপর নির্ভরশীল
এছাড়াও যদি আপনি নিয়মিত বিশ্বের ছোট ছোট অদ্ভুত, রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক বিষয় সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত থাকুন।
ফেইসবুক পেইজ:
ইউটিউব চ্যানেল:
ইনস্টাগ্রাম পেজ: The Earth Bangla
ফেইসবুক গ্রুপ:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not Enter any spam comment or Link in the comment Box