বাংলাদেশের শীর্ষ ১০ বিজ্ঞানী
বর্তমানে আমরা যে পৃথিবীকে দেখতে পারছি, আজ থেকে ১০০ বছর বা তারও আগে আমাদের পৃথিবী এমন ছিল না। পৃথিবীর এই পরিবর্তনের মূল কারণ হল বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানের কল্যাণে নতুন নতুন আবিষ্কার এই পরিবর্তনশীল পৃথিবীকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি আমাদের দেশ অর্থাৎ বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদেরও উল্লেখযোগ্য কিছু অবদান রয়েছে যা আমাদের বেশিরভাগেরই অজানা। The Earth Banglar সেরা ১০ সিরিজের আজকের পর্বে আমরা আপনাদের জানাবো বাংলাদেশের সেরা ১০ জন বিজ্ঞানী ও তাদের আবিষ্কার সম্পর্কে।
১০. ড. আতাউল করিম
মোহাম্মদ আতাউল করিম একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী। বিশ্বের পরিবহন সেক্টরে অবিশ্বাস্য পরিবর্তন এনেছিলেন তার আবিষ্কৃত ভাসমান ট্রেন চলাচল প্রযুক্তির মাধ্যমে যেখানে ট্রেন চলবে কিন্তু ট্রেনের চাকা লাইন বা ট্র্যাক স্পর্শ করবে না। চুম্বকের সাহায্যে এটি এগিয়ে চলবে এবং গন্তব্যে পৌঁছাবে চোখের পলকে। ড. আতাউল করিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্রুততম ভাসমান ট্রেন চলাচল প্রযুক্তি বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি বিশ্বের সেরা ১০০ জন বিজ্ঞানীর একজন। ২০০৪ সালে তিনি এই গবেষণা প্রকল্পের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং দেড় বছরেই ট্রেনটি নির্মাণ ও প্রাথমিক পরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন।
৯. আব্দুস সাত্তার খান
আব্দুস সাত্তার খান বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত মহাকাশ গবেষক। কর্মজীবনে তিনি ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটির machinery বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়াও নাসা ইউনাইটেড টেকনোলজিস এবং অ্যালস্টমে কাজ করার সময়ে ৪০টিরও বেশি সংকর ধাতু উদ্ভাবন করেছেন। এই সংকর ধাতুগুলো ইঞ্জিনকে আরো হালকা করেছে, যার ফলে উড়োজাহাজের পক্ষে আরো দ্রুত উড্ডয়ন সম্ভব হয়েছে এবং ট্রেনকে আরো গতিশীল করেছে। তার উদ্ভাবিত সংকর ধাতুগুলো এফ-১৬ ও এফ-১৭ যুদ্ধবিমানের জ্বালানি সাশ্রয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
আরো জানুন: বিজ্ঞানের অবাক করা ১০টি নতুন আবিষ্কার
৮. শুভ রায়
শুভ রায় একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী এবং প্রথম কৃত্রিম কিডনির আবিষ্কারক। এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক অসামান্য কীর্তি। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সহযোগী অধ্যাপক শুভ রায় ২০০২ সালে তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে কৃত্রিম কিডনি তৈরির কাজ শুরু করেন এবং এই দলটি ২০১২ সালে কৃত্রিম কিডনি তৈরি করতে সক্ষম হয় যা তারা অন্য প্রাণীর দেহে প্রতিস্থাপন করতে সফল হয়েছেন। ধারণা করা হয়, আরো ব্যাপকভাবে বিভিন্ন প্রাণীতে এই কৃত্রিম কিডনি প্রতিস্থাপন ও পরীক্ষার পর এটি মানবদেহে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হবে।
৭. অধ্যাপক আবুল হুসসাম
অধ্যাপক আবুল হুসসাম একজন বাংলাদেশী বিজ্ঞানী, তিনি দীর্ঘদিন গবেষণা করে কম খরচে ভূ-গর্ভস্থ আর্সনিকযুক্ত পানি পরিশোধনের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। তার কর্মজীবনের এক বৃহৎ অংশ কাটিয়েছেন ভার্জিনিয়াতে, গবেষণা কাজের জন্য। সেখানে তিনি বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারতীয় ভূখণ্ডের ভূগর্ভস্থ পানিতে থাকা আর্সেনিক ও এর প্রতিকার নিয়ে গবেষণা করেন।
তিনি এবং তার ছোট ভাই ডক্টর আবুল মুনির দু'জনে মিলে তৈরি করেন 'সোনো ফিল্টার' নামে খাবার পানি থেকে আর্সেনিক নিষ্কাশন করার যন্ত্র। তাদের তৈরি এই যন্ত্র টাইমস ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে ২০০৭ সালে পরিবেশ বিষয়ক অন্যতম সেরা আবিষ্কার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও প্রখ্যাত জার্নালে অধ্যাপক হুসসামের প্রায় শতাধিক প্রকাশনা রয়েছে তবে তার বিশ্বব্যাপী পরিচিতি এসেছে এই আর্সেনিক ফিল্টার আবিষ্কারের পর।
৬. মেঘনাদ সাহা
মেঘনাদ সাহা ছিলেন অবিভক্ত বাংলার একজন বাঙালি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি গণিত নিয়ে পড়াশোনা করলেও পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়েও গবেষণা করেছেন। তিনি ও তার সহকর্মী সত্যেন্দ্রনাথ বসু সর্বপ্রথম আলবার্ট আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতার সূত্রকে জার্মান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন যা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। তিনি পরমাণু বিজ্ঞান, আয়ন মণ্ডল, পঞ্জিকা সংস্কার, বন্যা প্রতিরোধ ও নদী পরিকল্পনা নিয়ে ব্যাপক অবদান রেখেছিলেন। এছাড়াও তাপীয় আয়নবাদ সংক্রান্ত তত্ত্ব উদ্ভাবন করে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।
আরো জানুন: বিজ্ঞান সম্পর্কে অজানা ও অবাক করা ১০টি তথ্য (তথ্য পর্ব-৪)
৫. প্রফুল্ল চন্দ্র রায়
স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাঙালি রসায়নবিদ, শিক্ষক, দার্শনিক ও কবি, যিনি পি সি রায় নামেও পরিচিত। তিনি নিজের বাসভবনে দেশীয় ভেষজ নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে তার গবেষণাকর্ম আরম্ভ করেন। এই গবেষণাস্থল থেকেই পরবর্তীকালে বেঙ্গল কেমিক্যালসের প্রতিষ্ঠা হয় এবং ১৮৯৫ সালে তিনি মারকিউরাস নাইট্রাইট (HgNO2) আবিষ্কার করেন যা বিশ্বব্যাপী আলোড়নের সৃষ্টি করে। এটি তার অন্যতম প্রধান আবিষ্কার। তিনি তার সমগ্র জীবনে মোট ১২ টি যৌগিক লবন এবং ৫টি থায়োএস্টার আবিষ্কার করেন। তাই বলা যায় বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ভারতীয় উপমহাদেশের শিল্পায়নে প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
৪. ড. মাকসুদুল আলম
মাকসুদুল আলম একজন বাংলাদেশি জিনতত্ত্ববিদ। তিনি ২০০৮ সালে বাংলাদেশের ৪২ জন বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদকে নিয়ে ‘স্বপ্নযাত্রা’ নামক একটি উদ্যোগের মাধ্যমে পাটের জিনোম সিকোয়েন্স গবেষণার সূত্রপাত করে। তার নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডাটাসফটের একদল উদ্যমী গবেষকের যৌথ প্রচেষ্টায় ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়ে সফলভাবে উন্মোচিত হয় পাটের জিন নকশা। ২০১০ সালের ১৬ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কারের ঘোষণা দেন। এছাড়াও তিনি ২০১২ সালে পাটের জন্য ক্ষতিকর ছত্রাক (মাক্রোফোমিনা ও ফেইজেওলিনার) জিনোম সিকোয়েন্স উদঘাটনে বাংলাদেশের একটি গবেষণা দলের নেতৃত্ব দেন।
৩. সত্যেন্দ্রনাথ বসু
সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন একজন বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী যার গবেষণার ক্ষেত্র ছিল গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞান। সত্যেন্দ্রনাথ বসু আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে যৌথভাবে বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান প্রদান করেন, যা পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বলে বিবেচিত হয়। তার গবেষণা পার্টিকেল স্ট্যাটিস্টিক্স ১৯২২ সালে আইনস্টাইন জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর গবেষণা কোয়ান্টাম থিওরির অনেক পথ খুলে দেয়। এছাড়াও কোয়ান্টাম ফিজিক্সের অনন্য আবিষ্কারের জন্য পদার্থবিজ্ঞানী পিটার হিগস ও বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামে নামকরণ করা হিগস-বোসন কণাটি ‘ঈশ্বর কণা’ হিসেবেও পরিচিত।
আরো জানুন: ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে অজানা ১৩টি তথ্য
২. ড. কুদরাত-এ-খুদা
ড. কুদরাত-এ-খুদা ছিলেন একজন বাংলাদেশী রসায়নবিদ, গ্রন্থাকার এবং শিক্ষাবিদ। তিনি গবেষণার প্রথম দিকে স্টেরিও রসায়ন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। পরবর্তীতে তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল বনৌষধি, পাট, লবণ, কাঠকয়লা, মৃত্তিকা ও অনান্য খনিজ পদার্থ। বিজ্ঞানী হিসাবে তার ও তার সহকর্মীদের ১৮টি আবিষ্কারের পেটেন্ট রয়েছে, যার মধ্যে ৯টি পাটসংক্রান্ত। এর মধ্যে পারটেক্স কাঠ কুদরাত-এ-খুদার বিশেষ অবদান। এছাড়াও তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন যে, সমুদ্রের পানিতে লবন ছাড়াও প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেশিয়াম সালফেট, ম্যাগনেশিয়াম ক্লোরাইড ও স্বল্পমাত্রায় ব্রোমিন থাকে।
১. জগদীশ চন্দ্র বসু
উদ্ভিদে প্রাণের অস্তিত্ব সর্বপ্রথম অনুভব করেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু। ১৯০০ সালের আগে বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু শুধুমাত্র পদার্থবিজ্ঞান নিয়েই গবেষণা করতেন। এক পযার্য়ে পদার্থ বিজ্ঞানের পাশাপাশি তার জীব বিজ্ঞানের প্রতিও আগ্রহ সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন অবস্থায় উদ্ভিদ কেমন সাড়া দেয় তা দেখার জন্য বিজ্ঞানী বসু গাজর, মুলা, বাদাম, শালগম, বেগুন, ফুলকপি সহ বেশ কয়েকটি উদ্ভিদ নিয়ে গবেষনা করেন। গবেষণার এক পর্যায়ে তিনি মনে করেন, বিদ্যুৎ প্রবাহে উদ্ভিদও উত্তেজনা অনুভব করে এবং সাড়া দিতে পারে। অর্থাৎ উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। ১৯১০ সালের দিকে তিনি তার গবেষণার পূর্ণাঙ্গ ফলাফল একটি বই আকারে প্রকাশ করেন। বইটির নাম ছিল ‘জীব ও জড়ের সাড়া’ বা Response in the Living and Non-Living। সে সময় এই বইটি পৃথিবী জুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে যার ফলে জগদীশচন্দ্র বসু পৃথিবীজুড়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।
এছাড়াও যদি আপনি নিয়মিত বিশ্বের ছোট ছোট অদ্ভুত, রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক বিষয় সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত থাকুন।
ফেইসবুক পেইজ:
ইউটিউব চ্যানেল:
ইনস্টাগ্রাম পেজ: The Earth Bangla
ফেইসবুক গ্রুপ:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not Enter any spam comment or Link in the comment Box