শীর্ষ ১০ নাস্তিক দেশ

নাস্তিকতা হল একটি দর্শন যা ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে স্বীকার করে না। সাধারণত সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না এমন মানুষকেই আমরা নাস্তিক বলে থাকি। নাস্তিকরা বিশ্বাস করে যে ঈশ্বরের অস্তিত্বের কোন প্রমাণ নেই, এবং ঈশ্বর একটি কল্পিত সত্তা। ২০২২ সালের একটি পরিসংখ্যান অনুসারে, বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৬% মানুষ নাস্তিক অর্থাৎ নাস্তিকতা যদি একটি ধর্ম হয়, তাহলে এটি বর্তমান বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ধর্ম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন হারে নাস্তিক বিদ্যমান এবং বিশ্বব্যাপী এই নাস্তিক জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান। The Earth Banglar সেরা ১০ সিরিজের আজকের পর্বে আমরা আপনাদের জানাবো বিশ্বের নাস্তিক ১০টি দেশ সম্পর্কে।

১০. ডেনমার্ক

ইউরোপের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ ডেনমার্ক একটি শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও এটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নাস্তিক জনসংখ্যার দেশগুলির মধ্যে একটি। ডেনমার্কের সরকার ধর্মনিরপেক্ষ এবং দেশটিতে ধর্মের উপর কোন সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই। যদিও অনেকের কাছে ডেনমার্ক একটি খ্রিস্টান দেশ হিসেবে পরিচিত তবে ২০২৩ সালের একটি জরিপ অনুসারে, ডেনমার্কের ৬৮% নাগরিক নিজেদের নাস্তিক বা ধর্মবিশ্বাসী নয় বলে দাবি করেছেন। ডেনমার্কে ধর্মের প্রতি এই অবিশ্বাসের বেশ কয়েকটি কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ডেনমার্কের একটি দীর্ঘ ধর্মনিরপেক্ষ ইতিহাস এবং ডেনমার্কের শিক্ষাব্যবস্থা। দেশটিতে কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে এটি একটি ইতিবাচক বিষয়, কারণ এটি ধর্মীয় সহিংসতা এবং বৈষম্য কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও, ডেনমার্ক সরকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে আর্থিকভাবে সহায়তা করে না।

৯. অস্ট্রেলিয়া

অস্ট্রেলিয়া একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, যার অর্থ সরকার কোন নির্দিষ্ট ধর্মকে সমর্থন করে না। ২০২৩ সালের একটি সমীক্ষা অনুসারে, অস্ট্রেলিয়ায় ১৪% মানুষ নিজেদেরকে নাস্তিক এবং ৫৫% মানুষ নিজেদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে পরিচয় দেয়। অর্থাৎ দেশটির মোট জনসংখ্যা ৬৯ শতাংশই ধর্মনিরপেক্ষ বা নাস্তিক এবং এই সংখ্যাটি গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় নাস্তিকতার বৃদ্ধির বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষার হার বৃদ্ধি, সামাজিক পরিবর্তন এবং বহুসংস্কৃতির মানুষ। ২০৩০ সালের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় নাস্তিকদের সংখ্যা ৯০% ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে, এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে অস্ট্রেলিয়ায় এখনও অনেক ধর্মীয় মানুষ রয়েছে।

আরো জানুন: বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০টি ধর্ম

৮. নরওয়ে

ইউরোপের আরেকটি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ নরওয়ে একটি নাস্তিক দেশ হিসেবে বিবেচিত হয় কারণ এর জনসংখ্যার বেশিরভাগ অংশ ধর্মবিশ্বাসী নয়। ২০২৩ সালের একটি জরিপ অনুসারে, নরওয়ের ৭০% মানুষ নিজেদেরকে ধর্মবিশ্বাসী বলে মনে করেন না। এর মধ্যে ২৯% মানুষ নিজেদেরকে নাস্তিক, ৩৮% মানুষ নিজেদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে মনে করেন, এবং ৪% মানুষ ধর্মবিশ্বাসী হলেও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত নন। নরওয়েতে ধর্মের উপর সরকারীভাবে কোনো বাধ্যতামূলক নিয়ম নেই। নাগরিকরা যেকোনো ধর্মে বিশ্বাস করতে বা না করতে স্বাধীন তবে ঐতিহ্যগতভাবে নরওয়ে একটি খ্রিস্টান দেশ। কিন্তু বর্তমানে নরওয়েতে ধর্মের জনপ্রিয়তা দিন দিন  হ্রাস পাচ্ছে।

৭. উত্তর কোরিয়া

উত্তর কোরিয়াকে একটি নাস্তিক দেশ বলা যেতে পারে, কারণ দেশটিতে ধর্মের উপর কঠোর বিধিনিষেধ এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাকে সীমিত করা হয়েছে। উত্তর কোরিয়ার সরকার ধর্মকে একটি বিদেশী আগ্রাসন বলে মনে করে। দেশটিতে ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং প্রচারণা নিষিদ্ধ। এছাড়াও ধর্মীয় গ্রন্থ এবং ধর্মীয় পোশাক রাখাও নিষিদ্ধ। এমনকি উত্তর কোরিয়ায় ধর্মবিশ্বাসের জন্য শাস্তিও হতে পারে। উত্তর কোরিয়ার সরকার ধর্মের পরিবর্তে জাতীয়তাবাদ এবং ব্যক্তিগত নেতা কিম জং-উনের প্রতি ভক্তিকে জনগণের মধ্যে উৎসাহিত করে। ফলে উত্তর কোরিয়ায় ধর্মের উপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণের কারণে, অনেক উত্তর কোরিয়ান নাস্তিক হয়ে ওঠে। দেশটির জনসংখ্যার মধ্যে ধর্মবিশ্বাসের পরিমাণ সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তবে, কিছু সূত্র অনুসারে, দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৭১% নাস্তিক।

৬. বেলজিয়াম

বেলজিয়াম একটি ইউরোপীয় দেশ যা তার ধর্মীয় বৈচিত্র্যের জন্য পরিচিত। ২০২৩ সালের একটি জরিপ অনুসারে, বেলজিয়ামের জনসংখ্যার প্রায় ৭২% নাস্তিক বা কোন ধর্মকেই অনুসরণ করে না যা তাদেরকে ইউরোপের অন্যতম নাস্তিক দেশ করে তোলে। বেলজিয়ামের সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করে, এবং দেশটির ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য সুরক্ষা প্রদান করে। বেলজিয়ামের সরকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে আর্থিকভাবে সমর্থন করে না এবং ধর্মীয় শিক্ষাকে স্কুল থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এছাড়াও অভিবাসন বেলজিয়ামের ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে বাড়িয়ে তুলেছে। 

আরো জানুন: বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০টি মুসলিম দেশ

৫. যুক্তরাজ্য

ঐতিহাসিকভাবে, যুক্তরাজ্য একটি খ্রিস্টান দেশ ছিল, কিন্তু এখন এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সাংবিধানিকভাবে যুক্তরাজ্য একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও দেশটিতে ধর্মীয় বিশ্বাসের হার ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। ২০২৩ সালের একটি জরিপ অনুসারে, যুক্তরাজ্যের মাত্র ২০% জনসংখ্যা নিজেকে খ্রিস্টান বলে দাবি করে এবং ৭৩% প্রাপ্তবয়স্করা নিজেদেরকে নাস্তিক বা ধর্মহীন বলে দাবি করেছেন। কিন্তু দেশটিতে এখনও অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষ রয়েছে। তবে, নাস্তিকতার বৃদ্ধি যুক্তরাজ্যের সমাজে বেশ কিছু পরিবর্তন আনছে। উদাহরণস্বরূপ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির প্রভাব হ্রাস পাচ্ছে এবং ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধগুলি আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে।

৪. চেক প্রজাতন্ত্র

চেক প্রজাতন্ত্র একটি ইউরোপীয় দেশ যা তার নাস্তিক জনসংখ্যার জন্য পরিচিত। ২০২৩ সালের একটি জরিপ অনুসারে, চেক প্রজাতন্ত্রের প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ থেকে ৭৫% ভাগ অধিবাসী কোন ধর্মে বিশ্বাসী নয়। চেক প্রজাতন্ত্রে নাস্তিকতার উত্থানের বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। দেশটি দীর্ঘদিন কমিউনিস্ট শাসনের অধীনে ছিল যেখানে ধর্মীয় দমন ও নিপীড়ন করা হতো। এছাড়াও চেক প্রজাতন্ত্রের স্কুলগুলিতে ধর্ম শিক্ষা বাধ্যতামূলক নয়। এই কারণে, অনেক মানুষ ধর্মের সাথে পরিচিত নয় এবং এতে বিশ্বাস করে না। বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্রে, নাস্তিকতা একটি স্বাভাবিক এবং গ্রহণযোগ্য অবস্থান হিসাবে দেখা হয়।

৩. সুইডেন

সুইডেন একটি ইউরোপীয় দেশ যা তার উদার মূল্যবোধ এবং সামাজিক কল্যাণ ব্যবস্থার জন্য পরিচিত। দেশটিতে ধর্মের উপর একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে নাস্তিকতার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালের সুইডেনের একটি সরকারি হিসেব অনুযায়ী দেশটির মাত্র ৮ ভাগ মানুষ উপাসনালয়ে গিয়ে ধর্ম চর্চা করেন এবং প্রায় ৭৮% নিজেদেরকে নাস্তিক বা ধর্মহীন বলে দাবি করেন যা ইউরোপের মধ্যে সর্বোচ্চ। নাস্তিকতার বৃদ্ধি সুইডেনের সমাজে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। উদাহরণস্বরূপ, সুইডেনের জনসংখ্যার একটি বৃহত্তর অংশ এখন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগদান করে না। এছাড়াও, সুইডেনের আইন এবং নীতিগুলি ধর্মের উপর কম নির্ভরশীল হয়ে উঠছে।

আরো জানুন: বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ১০টি মুসলিম দেশ

২. জাপান

জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত দেশ জাপান জনসংখ্যায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় নাস্তিক দেশগুলির মধ্যে অন্যতম। যদিও অনানুষ্ঠানিকভাবে জাপানের রাষ্ট্রীয় ধর্ম  শিন্তো ধর্ম। এটি জাপানের স্থানীয় প্রচলিত একটি  ধর্ম যার কোনো ঈশ্বর নেই, ধর্মগ্রন্থ নেই, পরকাল নেই, কোনো বিধিবদ্ধ রীতিনীতিও নেই। মূলকথা হলো সৃষ্টিকর্তা বলতে কেউ নেই। অথাৎ শিন্তো ধর্মের অনুসারীরাই মূলত নাস্তিক। জাপানের ৮১% মানুষ বিভিন্ন ভাবে শিন্তো রীতিনীতি পালন করে এবং শিন্তো ধর্মের উৎসবগুলোতে অংশগ্রহণ করে। তবে জাপানের খুব অল্প সংখ্যক মানুষ নিজেদেরকে শিন্তো ধর্মানুসারী বলে পরিচয় দেয়। তাই জাপানকে প্রত্যক্ষভাবে নাস্তিক দেশ বলা না গেলেও পরোক্ষভাবে এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম নাস্তিক দেশ।

১. চীন

বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল দেশ হলো চীন যার শতকরা ৯১ ভাগ মানুষই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। অথাৎ চীনেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নাস্তিক বাস করেন। ২০২৩ সালের একটি জরিপ অনুসারে, দেশটির শতকরা ৬১ ভাগ মানুষ সরাসরি সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন, বাকি ৩০ ভাগ নিজেদের ধর্মে বিশ্বাসী নন বলে দাবি করেছেন। কট্টর নাস্তিকের সংখ্যা ১৪-১৫%। চীনে নাস্তিকতার বৃদ্ধির প্রধান কারণ হল কমিউনিস্ট পার্টির ধর্মনিরপেক্ষ নীতি এবং চীনের শিক্ষা ব্যবস্থা যেখানে চীনের সরকার ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রচার করে। তবে চিনের কিছু স্থানীয় লোকধর্ম রয়েছে। তাই চীনারা তাদের দেবদেবী ও ধর্মীয় নেতাদের বিশালাকার মূর্তি বানিয়ে থাকে। যার ফলে বিশ্বের সর্বোচ্চ ও সর্ববৃহৎ দেবমূর্তিগুলির অনেকগুলিই চীনে অবস্থিত।

এছাড়াও যদি আপনি নিয়মিত বিশ্বের ছোট ছোট অদ্ভুত, রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক বিষয় সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত থাকুন।

ফেইসবুক পেইজ: The Earth Bangla

ইউটিউব চ্যানেল: The Earth Bangla

ইনস্টাগ্রাম পেজ: The Earth Bangla

ফেইসবুক গ্রুপ: The Earth Bangla Family


Post a Comment

Please do not Enter any spam comment or Link in the comment Box

নবীনতর পূর্বতন