বিশ্বের বৃহত্তম ১০টি সাগর

মহাসাগরের কথা আমরা কম বেশি সবাই জানলেও পৃথিবীতে মোট কতটি সমুদ্র রয়েছে বা সাগর ও মহাসাগরের মধ্যে মূলত পার্থক্য কি তা আমাদের অধিকাংশই অজানা। মূলত সাগর হল মহাসাগরের লবণাক্ত জলের উপকূলবর্তী অঞ্চল যা পৃথিবীর পৃষ্ঠের ৭০% এরও বেশি অংশ জুড়ে রয়েছে। সমুদ্রগুলি সাধারণত মহাসাগরের তুলনায় ছোট এবং কম গভীর হয়। পৃথিবীর প্রতিটি মহাসাগরের উপকূলে বেশ কয়েকটি সমুদ্র রয়েছে। তবে কিছু সাগর মহাসাগরের সাথে সরাসরি সংযুক্ত নয়। সমুদ্র পৃথিবীর জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং পানি চক্র, কার্বন চক্র ও নাইট্রোজেন চক্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। The Earth Banglar সেরা ১০ সিরিজের আজকের পর্বে আমরা আপনাদের জানাবো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০টি সাগর সম্পর্কে।

১০. গিনি উপসাগর

গিনি উপসাগর হল আটলান্টিক মহাসাগরের একটি উপসাগর, যা আফ্রিকার উত্তর পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত। এটি উত্তরে সেনেগাল থেকে দক্ষিণে গ্যাবনে পর্যন্ত বিস্তৃত। গিনি উপসাগরের আয়তন প্রায় ২৩ লক্ষ ৫০ হাজার বর্গকিলোমিটার যা বিশ্বে ১০ম বৃহত্তম এবং গড় গভীরতা প্রায় ২,২০০ মিটার। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ, যা আফ্রিকা ও ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্যকে সংযুক্ত করে। গিনি উপসাগর একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল, যেখানে তেল, গ্যাস, খনিজ এবং মাছ সহ প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। এছাড়াও গিনি উপসাগরের উপকূল অঞ্চলটি খুবই উর্বর এবং এখানে অনেক নদী প্রবাহিত হয়। এই উপসাগরে বহু নদী পতিত হয়েছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাইজার এবং ভোল্টা নদী।

৯. ভূমধ্যসাগর

ভূমধ্যসাগর এশিয়া,ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যবর্তী একটি সাগর। এটি আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে জিব্রাল্টার প্রণালী দ্বারা সংযুক্ত। এর উত্তরে আল্পস এবং বলকান পর্বতমালা, দক্ষিণে সাহারা মরুভূমি, পূর্বে আরব উপদ্বীপ এবং পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর অবস্থিত। ভূমধ্যসাগরের আয়তন প্রায় ২৫ লক্ষ বর্গকিলোমিটার যা বিশ্বে ৯ম বৃহত্তম সমুদ্র এবং এর গড় গভীরতা প্রায় ১,৫০০ মিটার। তবে ভূমধ্যসাগরের সর্বোচ্চ গভীরতা প্রায় ৫,১০৯ মিটার। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ যা ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকাকে সংযুক্ত করে। ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলির মধ্যে বাণিজ্য, পর্যটন এবং মৎস্য শিল্পে  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই সমুদ্রটি। এখানকার সমুদ্রের তলদেশে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি পাওয়া যায়।

আরো জানুন: বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০টি মরুভূমি

৮. ক্যারিবিয়ান সাগর

ক্যারিবিয়ান সাগর উত্তর আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের মধ্যে অবস্থিত একটি সমুদ্র যা আটলান্টিক মহাসাগরের একটি উপসাগর। ক্যারিবিয়ান সাগরের মোট আয়তন প্রায় ২৭ লক্ষ ৫৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার যা বিশ্বে ৮ম বৃহত্তম  এবং এর গড় গভীরতা প্রায় ২,৪৯৬ মিটার। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ, যা উত্তর আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকাকে সংযুক্ত করে। ক্যারিবিয়ান সাগরে প্রায় ৭০০ টি দ্বীপ রয়েছে। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় দ্বীপগুলি হল কিউবা, হাইতি, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র, জামাইকা এবং ত্রিনিদাদ ও টোবাগো যা এই অঞ্চলের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। অঞ্চলটি তার সুন্দর সমুদ্র সৈকত, উষ্ণ জলবায়ু এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত।

৭. ওয়েডেল সাগর

ওয়েডেল সাগর হল দক্ষিণ মহাসাগরের একটি অভ্যন্তরীণ সাগর যা অ্যান্টার্কটিকার পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। এই সাগরের নামকরণ করা হয়েছে ইংরেজ নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেমস ওয়েডের নামে। তিনি ১৮২১ সালে এই সাগরটি আবিষ্কার করেন। ওয়েডেল সাগরের আয়তন প্রায় ২৮ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার যা বিশ্বে ৭ম বৃহত্তম এবং এর গড় গভীরতা প্রায় ২,৭০০ মিটার। ওয়েডেল সাগরের পানি অত্যন্ত ঠান্ডা এবং এই সাগরের বেশিরভাগ অংশ বরফে ঢাকা থাকে। এটি বিশ্বের বৃহত্তম বরফের সমুদ্র এবং বিশ্বের বরফের মোট আয়তনের প্রায় ১০% এর আবাসস্থল।

৬. দক্ষিণ চীন সাগর

দক্ষিণ চীন সাগর হল একটি প্রান্তিক সাগর যা পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত। এটি প্রায় ৩৫ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এবং এটি বিশ্বের ৬ষ্ঠ বৃহত্তম সাগর। দক্ষিণ চীন সাগরের উত্তরে চীন, পূর্বে তাইওয়ান, দক্ষিণে মালয়েশিয়া, ব্রুনাই এবং ইন্দোনেশিয়া এবং পশ্চিমে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া এবং থাইল্যান্ড অবস্থিত। দক্ষিণ চীন সাগর একটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ। এটি বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত সমুদ্রপথগুলির মধ্যে একটি এবং এটি বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়াও সাগরটির সমুদ্রতলে বিশাল খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ নিচে রয়েছে। তবে দক্ষিণ চীন সাগর একটি বিতর্কিত অঞ্চল। চীন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, ফিলিপাইন এবং থাইল্যান্ড এই সাগরের বেশ কয়েকটি দ্বীপের উপরে নিয়ন্ত্রণের জন্য বিরোধ রয়েছে।

আরো জানুন: বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০ টি দ্বীপ

৫. শৈবাল সাগর বা সারগাসো সমুদ্র

সারগাসো সমুদ্র বা শৈবাল সাগর হল উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যবর্তী অংশে অবস্থিত একটি সমুদ্র। এটি হলো সমুদ্রের মাঝে স্রোতহীন অঞ্চল, যেখানে শৈবাল ও অন্যান্য আগাছা জন্মায়। এটি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম সমুদ্র যার আয়তন ৩৫ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এবং এর গড় গভীরতা ৫ হাজার মিটার। এটি পৃথিবীর একমাত্র সাগর যার কোনো উপকূল নেই। সারগাসো সাগরের নামকরণ করা হয়েছে সারগাসাম নামক এক ধরনের সামুদ্রিক শৈবালের নামে, যা এই সমুদ্রে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। শৈবালগুলি জলের পৃষ্ঠে ভাসমান থাকে এবং এগুলি একটি বিশাল জাল তৈরি করে যা জাহাজগুলির চলাচলকে বিঘ্নিত করতে পারে। তবে এটি বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রজনন এবং আশ্রয়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল।

৪. আরব সাগর

আরব সাগর হল ভারত মহাসাগরের একটি উপসাগর যার পশ্চিমে রয়েছে আরব উপদ্বীপ এবং পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশ। প্রায় ৩৮ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার আয়তন নিয়ে আরব সাগর বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম সমুদ্র যার গড় গভীরতা ২,৭৩৪ মিটার এবং সর্বোচ্চ গভীরতা ৪,৬৫২ মিটার। এর উত্তরে ইরান ও পাকিস্তান। দক্ষিণে এটি ভারত মহাসাগরের মূল অংশের সাথে মিলে গেছে। আরব সাগর একটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ যা ভারত মহাসাগর এবং ভূমধ্যসাগরকে সংযুক্ত করে। এটি বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত সমুদ্রপথ যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার জাহাজ এই সমুদ্রপথে চলাচল করে। এটি একটি সমৃদ্ধ মৎস্যক্ষেত্র এবং এর জলে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। আরব সাগর একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র কারণ এর উপকূলে অনেক বিখ্যাত সমুদ্র সৈকত রয়েছে। এছাড়াও পাকিস্তানের করাচি এবং ভারতের মুম্বাই এই সাগরের তীরে অবস্থিত প্রধান সমুদ্র বন্দর।

৩. আমেরিকান ভূমধ্যসাগর

আমেরিকান ভূমধ্যসাগর হল আমেরিকান সরকার দ্বারা ব্যবহৃত একটি শব্দ যা মূলত ক্যারিবিয়ান সাগর এবং মেক্সিকো উপসাগরকে একত্রে বোঝায়। তবে আমেরিকান ভূমধ্যসাগর নামের সাথে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ অপরিচিত। এটি কিউবা, জ্যামাইকা, হিস্পানিওলা এবং অসংখ্য ক্যারিবিয়ান দ্বীপ নিয়ে বিস্তৃত। আমেরিকান ভূমধ্যসাগর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সমুদ্র যার আয়তন ৪২ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এবং এর গড় গভীরতা ২,২১৬ মিটার, তবে এর সর্বোচ্চ গভীরতা ৭,৬৮৬ মিটার। আমেরিকান ভূমধ্যসাগরের অঞ্চলটি পর্যটন, বাণিজ্য এবং মৎস্য শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য, যেখানে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক আসে।

আরো জানুন: পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ১০টি জঙ্গল

২. কোরাল সাগর

কোরাল সাগর হল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি সমুদ্র যা অস্ট্রেলিয়া, পাপুয়া নিউ গিনি, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া দ্বারা বেষ্টিত। এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র যার আয়তন প্রায় ৪৮ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। এর গড় গভীরতা ৪,৭৯১ মিটার এবং সর্বোচ্চ গভীরতা ৯,১৪০ মিটার। কোরাল সাগর অস্ট্রেলীয় উত্তর-পূর্ব উপকূল হতে ২,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়গুলির মধ্যে একটি এবং বিশ্বের বৃহত্তম প্রবাল প্রাচীর প্রণালী, গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের আবাসস্থল। এছাড়াও কোরাল সাগর একটি সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য অঞ্চল। এখানে প্রায় ৪ হাজার প্রজাতির মাছ, ১,৫০০ প্রজাতির শেলফিশ, ৪০০ প্রজাতির প্রবাল এবং ১ হাজার প্রজাতির সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবাসস্থল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জীববৈচিত্র্যের কারণে প্রতি বছর এটি লক্ষ লক্ষ পর্যটককে আকর্ষণ করে।

১. ফিলিপাইন সাগর

ফিলিপাইন সাগর হচ্ছে ফিলিপাইনের পূর্ব ও উত্তরপূর্বে অবস্থিত একটি প্রান্তিক সমুদ্র যা আয়তনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্র। এর আনুমানিক আয়তন প্রায় ৫৭ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এবং গড় গভীরতা প্রায় ৪,১০০ মিটার বা ১৩,৪০০ ফুট । বিশ্বের সবচেয়ে গভীরতম সমুদ্রখাত মারিয়ানা ট্রেঞ্চ হচ্ছে এই সাগরের গভীরতম বিন্দু। সাগরটির দক্ষিণে দক্ষিণ চীন সাগর, উত্তরে জাপান সাগর, পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর এবং পশ্চিমে তাইওয়ান দ্বীপপুঞ্জ দ্বারা সীমাবদ্ধ। এই সাগরের বৃহত্তম দ্বীপ হল উত্তর ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ। ফিলিপাইন সাগর একটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ যা প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরকে সংযুক্ত করে। এটি বিশ্বের বৃহত্তম জাহাজ চলাচলকারী রুটের মধ্যে একটি। এই সাগরের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ১০০ মিলিয়ন টন পণ্য পরিবহন হয়। এছাড়াও ফিলিপাইন সাগরের জলে প্রচুর পরিমাণে মাছ এবং অন্যান্য সামুদ্রিক সম্পদ রয়েছে। তবে ফিলিপাইন সাগর একটি বিতর্কিত অঞ্চল। কারণ চীন, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, মায়ানমার, ব্রুনাই এবং মালয়েশিয়া সকল দেশ এই সাগরের নিয়ন্ত্রণের দাবি করে।

এছাড়াও যদি আপনি নিয়মিত বিশ্বের ছোট ছোট অদ্ভুত, রহস্যময় ও আশ্চর্যজনক বিষয় সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত থাকুন।

ফেইসবুক পেইজ: The Earth Bangla

ইউটিউব চ্যানেল: The Earth Bangla

ইনস্টাগ্রাম পেজ: The Earth Bangla

ফেইসবুক গ্রুপ: The Earth Bangla Family

Post a Comment

Please do not Enter any spam comment or Link in the comment Box

নবীনতর পূর্বতন